Thursday, August 13

শৈশবের মহানায়ক:বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান


মিলন কান্তি দাস : এটা আমার শৈশবের কথা বলছি। একজন মানুষের শৈশব জীবন মানে একটি সম্পূর্ণ আলাদা কিছু। শৈশব মানেই একটি সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রমধর্মী অনুভূতি। তাইতো প্রতিটি স্বপ্নময় মানুষ তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করে। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে একজন মানুষ তার হৃদয়ের আত্মতৃপ্তি খুজে পায়। আমার কাছেও আমার শৈশব মানে আলাদা একটি কিছু। তাইতো বারংবার শৈশবের স্মৃতিচারন করি। নানা রঙের সেই দিনগুলির স্মৃতি চারন করে খুজে পাই এক ধরনের স্বর্গীয় আত্মতৃপ্তি। খুব ছোটবেলায় আমার নিয়মিত অভ্যাসগুলির অন্যতম একটি অভ্যাস ছিল কোন ভালো বক্তার বক্তব্য শোনা। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের হাতের তর্জনী উচিয়ে মায়াকান্না ঝরানো বক্তব্য আমাকে বিমুগ্ধ করতো। অপলক দৃষ্টিতে হা করে চেয়ে চেয়ে নেতাদের বক্তব্য শোনতাম। সেই থেকে বক্তব্য শোনার সূচনা, যা অদ্যবধি চলছে। তবে আগেকার দিনে নেতারা তাদের মায়াকান্না ঝরানো বক্তব্যে যা বলতো, তার সবটুকুই বিশ্বাস করে ফেলতাম। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বক্তব্য শোনার অভ্যাসে তেমন একটা পরিবর্তন না এলেও, বক্তব্য থেকে প্রাপ্ত বিশ্বাসে আমুল পরিবর্তন এসেছে। এখনকার বক্তব্যকে বক্তব্য মনে হয় না। এক ধরনের ডিগবাজি মনে হয়। মানুষের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে মনে হয়। আগে সাধারণ মানুষও সবকথা বিশ্বাস করে নিতো। এখন সাধারনদের বিশ্বাসেও অসাধারণ পরিবর্তন চলে এসেছে। এখন সাধারন মানুষও আর আগের মতো বক্তব্যের কথাগুলো বিশ্বাস করে না। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, একজন ভালো বক্তার বক্তব্য থেকে শিক্ষনীয় অনেক কিছু আছে। একজন ভালো বক্তা একটি সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চিন্তাধারার ব্যাপক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে। তাছাড়া বক্তব্য শোনাটাও একজন মানুষের মৌলিক গুণের অন্যতম একটি গুণ বলে আমি চিন্তা করি। সেই শৈশবকালে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী ছিলাম, তখন থেকেই স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস (বর্তমান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস), পালনের স্বতস্ফুর্ত চর্চা বাঙালী জাতির মধ্যে লক্ষ্য করে আসছি। অনেকটা না বুঝেই তখন বড়দের সাথে মিছিল সহকারে শহীদ মিনারে যেতাম। একুশের প্রভাত ফেরীতে প্রচন্ড শীতের সময়ও খালি পায়ে শহীদ মিনারে যেতাম। সেই যাওয়ার মধ্যে কি যেন একটা আত্মতৃপ্তি পেতাম। সাথে বড়দের কন্ঠে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিটি শোনার পর আমার সেই সময়ের কোমলমতি শিশু হৃদয়ের প্রতিটি ধমনী, প্রতিটি শিরা শিহরিত হতো। কেন জানি মনে হতো এই সবের মাঝেই আমার আনন্দ লুকিয়ে আছে, লুকিয়ে আছে আমার ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেতনা। তার চেয়ে বেশি ভালো লাগতো সে সময়ের এই জাতীয় দিবসগুলিতে রাস্তায় রাস্তায় দিনব্যাপী পাতানো ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকার ঐতিহাসিক ভাষন। রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় প্রথম যেদিন শুনেছিলাম সেই বজ্রকন্ঠে “ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি”। কন্ঠটি শোনার সাথে সাথেই মনে হয়েছে যে আসলে যিনি বক্তব্য দিচ্ছেন তিনি সীমাহীন দুঃখ বেদনা নিয়ে আজ কোথায় জানি এই বক্তব্যটি দিচ্ছেন। যে দুঃখের এপার আছে কিন্তু ওপার নেই। এ ধরনের কোন দুঃখ নিয়ে এই নেতা বক্তব্য দিচ্ছেন। সাথে সাথেই নেতার দুঃখের কথাগুলো বুঝে না বুঝে শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে যেতাম।
দিবসগুলোতে দিন ব্যাপী শোনতাম নেতার বজ্রকন্ঠে তার দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সব কথা, সব বাক্য। সবগুলি কথার মধ্যেই কি যেন এক অলৌকিক শিক্ষা লুকায়িত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে খুজতে লাগলাম সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইনের যথাযথ অর্থ। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম যে এই মহান নেতার দুঃখটা তার ব্যাক্তিগত কোন দুঃখ নয়, নয় তার পারিবারিক দুঃখ। সে দিনের সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু যে তার দুঃখের কথাগুলো বজ্রকন্ঠে উচ্চারন করেছিলেন সেই দুঃখটি ছিল একটি জাতীর দীর্ঘ পনে দুই শত বছরের ব্রিটিশ শাসন নির্যাতন এবং ২৪ বছরের পাকিস্থানী শাসন শোষন নির্যাতন থেকে প্রাপ্ত সীমাহীন দুঃখ ও পুঞ্জিভূত দুঃখের ইতিহাস। একটি জাতীয় পুঞ্জিভুত দুঃখকে সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু থেকে মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের তার ঐতিহাসিক বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন। সেই বক্তব্যের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি আইন একের পর এক অবিসংবাদিত এই নেতার কন্ঠে সুনিপণ ভাবে এবং ধারাবাহিক ভাবে সাজানো। এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটি জাতীর দুঃখের কথাকে যেমন উপস্থাপন করেছিলেন, তেমনি সেই দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের ক্ষেত্রে সেই সময়ের দুর্দশাগ্রস্ত বাঙ্গালী জাতীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙ্গালী মনোবল দৃঢ় ও চাঙ্গা করার নির্দেশনাও ছিল এই বক্তব্যের প্রতিটি লাইনে। ছিল আকারে ও ইঙ্গিতে স্বাধীনতার ঘোষনাও। বক্তব্যের একটি লাইনে ছিল, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, আমি এই বাংলার মানুষের অধিকার চাই।” এই উক্তিটি সেই থেকে আমার হৃদয়ে নাড়া দিতো। সেই সময়ই আমার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, এই মানুষটি সত্যিকারের একজন নিলোর্ভ রাজনীতিবিদ। পরবর্তীতে বই পুস্তক পড়ে, বয়োজৈষ্ট্যদের কাছ থেকে সহ নানা ভাবে জানা হয়ে গেলো আমার শৈশব জীবনের সেই মহানায়কের কথা। আমার শৈশবের সেই মহানায়ক জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই শৈশবে ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখতো, আর আমি এই মহান ব্যক্তির মতো রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। মূলত এই মহান নেতার ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষন আমার জীবন দর্শনকে প্রভাবিত করে ফেলে। আমার কেন জানি সেই সময় থেকেই মনে হতো এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে এই মহান নেতার মতো বেঁচে থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মতো পৃথিবীতে একদিনও বেঁচে থাকাও স্বার্থক বলে আমি মনে করি। বঙ্গবন্ধুর তুলনা বঙ্গবন্ধুই। অনেকেই এই অবিসংবাদিত বিশ্বনেতার সাথে অমুক আর তমুকের তুলনা করার দৃষ্টতা দেখায়। অনেকে এই মহান নেতাকে নিয়ে কটুক্তিও করেন, কিন্তু যে যাই করুক না কেন, বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই এটই ধ্রুব সত্য। বঙ্গবন্ধু একটি অমর মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনার নাম। বঙ্গবন্ধু একটি শোষিত বঞ্চিত জাতির লাঞ্চনা বঞ্চনা থেকে মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টার নাম। সুতরাং এই মহান নেতাকে নিয়ে কটুক্তিকারীরা কে, কি বা কোথা থেকে এসেছে তা নতুন করে কিছু বলার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করিনা। আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, যারা মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক তাদেরকে নিয়ে কুৎসা রটনা করে কোন লাভ হবেনা। বরং ঐ অথর্বরাই ইতিহাসের আস্থাকুড়ে নিক্ষেপিত হবে। পরিশেষে শুধু একটি কথাই বলবো যে, বঙ্গবন্ধুকে কাউকে চেনাতে হয় না। একজন বাঙ্গালীর স্বীয় বিবেক এবং চেতনাই আপনা আপনি ভাবে বঙ্গবন্ধুকে চিনে ফেলে। আমাকেও যেমন কেউ বঙ্গবন্ধু চিনিয়ে দেয়নি, তেমনি এদেশের নতুন প্রজন্মের বাচ্চাদেরও বঙ্গবন্ধুকে কেউ চিনিয়ে না দিলেও তারা চিনে ফেলে। কারন বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনীতিবিদদের কাউকে চিনিয়ে দেওয়া লাগেনা। ইতিহাসই এই মহানায়কদের চিনিয়ে দেয়। আর ইতিহাসের পাতাকে মিথ্যা দিয়ে সাজিয়ে যদি কেউ মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সেই বরং ইতিহাসের আস্থাকুড়ে নিক্ষেপিত হয়। ইতিহাত জাতীর এই খলনায়কদের ক্ষমা করে না। আর বঙ্গবন্ধুর মতো মহানায়করা বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে, প্রতিটি ঘরে ঘরে এবং শ্রদ্ধার পরশে। শৈশবে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন ত্যাগী নেতা হওয়ার স্বপ্ন এই বাংলার অসংখ্য অগণিত শিশু দেখে। বাংলার এই ক্ষুদে শিশুগুলো এই বয়সে বুঝে না বুঝে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানটি শিখে ফেলে। সুতরাং এটাই বলা যায় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু একজন অনন্য ও অতুলনীয় রাজনীতিবিদ। তাইতো আগস্টের এই শোকাবহ মাসে বিন¤্র চিত্তে স্মরণ করি- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধুকে। হয়তো তাতে মিলে আত্মতৃপ্তি, বা একটু স্বান্তনা।

মিলন কান্তি দাস
বি.কম (অনার্স), এম.কম (হিসাব বিজ্ঞান)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়