Thursday, December 7

কানাডার ভিজিট ভিসা ও ৯০ দশকের সানলাইট ব্যাটারির গল্প


সরওয়ার ফারুকী::

শির দশকে মধ্যপ্রাচ্যফেরত যুবাদের ঢেউ লেগেছিল গ্রামেগঞ্জে, বিশেষত সিলেটে। গায়ের বাহারি কাপড়, পারফিউমের মৌ-মৌ গন্ধ আর পায়ের চিকওলা জুতোর চিক্যে মজেছিলেন কন্যাগ্রস্থ বাবারা। বিয়ের বাজারে তাদের মোকাবিলায় দেশের শিক্ষিত যুবকশ্রেণি ছিলেন অসহায়, বিপর্যস্ত। চোখের সামনে কল্পনার অস্পরিদের একে-একে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রবাস-ফেরত শার্দূলরা।

সে সময় প্রবাসফেরতদের কাছে জনপ্রিয় এক ফ্যাশন ছিল টেপরেকর্ডার সাথে নিয়ে আসা। কে কতবড় রেকর্ডার নিয়ে ফিরলেন—তার অন্তর্দন্দ চলছিল নিজেদের মধ্যে। ইয়ামোটা রেকর্ডার বাড়িতে, বাজারে ফুল ভলিউমে বাজিয়ে আনন্দ পেতেন তাঁরা। শিক্ষিত প্রবাসীরা শুনতেন পুরনো হিন্দি ফিল্মের গান। শামসাদ বেগমের 'সাইয়্যা দিল ম্যে আনা রে, আঁখে ফিরনা যানা রে' গানের তালেতালে মাথা দুলাতেন, সুরও ধরতেন, কিংবা মুহাম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকারের গানের সাথে ঠোঁট মেলাতেন। লেখাপড়া যাদের নেই; তারা শুনতেন আমির উদ্দীন কিংবা বাংলা সিনেমার গান। বিশ্ববিখ্যাত ক্বারি আব্দুল বাসিতের অপূর্ব সুরের তেলাওয়াত এ সময়কালেই শোনার সুযোগ হয়, প্রবাসীদের রেকর্ডারের কল্যাণে বাসিতের তেলাওয়াত শুনে মানুষের মন বিগলিত হয়। বিদেশ থেকে সে-সব রেকর্ডারে রেকর্ড করে অনেকেই আবার মা-বাবার কাছে নিজেদের সুখদুঃখের ক্যাসেট পাঠাতেন, মায়েদের কথাও রেকর্ড করে নিয়ে যেতেন সাথে। 

আমাদের বাড়িতে রক্ষনশীল চরিত্রের দাপটে টেপরেকর্ডার ছিল অবাঞ্ছিত। ৮৮/৮৯ সালে ওমান থেকে বাবা নিয়ে এলেন ইয়ালম্বা এক টেপরেকর্ডার। টেবিলে রাখলে এপারওপার ছুঁয়ে যায়! দাদীর ক্রোধান্বিত চোখের তেজে সে রেকর্ডার দুই দিনও থাকতে পারেনি ঘরে, বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সে রেকর্ডারের বটমের নীচে লাল-নীল বাতি জ্বলতো, আজও সে বাতিগুলো মনের কোণে ঝলমল জ্বলছে, চোখ মুদলেই দেখতে পাই!

সে সময়ের শোনা গল্প আর আজকের শিরোনামে নেমে আসি এবার। আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক প্রবাসী নিয়ে এলেন এমনই এক বাত্তি-জ্বলা টেপরেকর্ডার। সে রেকর্ডার অন করলে বটমের নীচে, স্পিকারের চারপাশে নানা রঙের বাতি জ্বলে। কিন্তু, দেশে ফেরার পরদিন সে রেকর্ডার অন করতে গেলেই বাঁধলো বিপত্তি, কোনোভাবেই তা অন হচ্ছিল না। উত্তেজনায় ঘেমে উঠলেন নবাগত, হাতে নিয়ে ঝাঁকালেন, কিন্তু বেয়াড়া রেকর্ডার কোনোভাবেই অন হলো না। অবশেষে কেউ-একজনের পরামর্শে সে রেকর্ডার নিয়ে গেলেন কানাইঘাট বাজারে। সাধের, স্বপ্নের রেকর্ডারের এমন দুর্ব্যবহারে দেশে ফেরার আনন্দ তার মজে গেল! সবাই আশ্বাস দিল, বললো, কানাইঘাটের ঐ মেকারের কাছে গেলে ঠিক হয়ে যাবে, একটুও চিন্তা করো না, এবার ভাত খাও, মুখটা শুকিয়ে গেল যে!

বাজারের মেকার নতুন সে রেকর্ডার হাতে নিয়ে দেখল, কিন্তু কোনো বিমার পেল না। যখন ব্যাটারি-বক্সের কাভার খুলল, তখনই দেখল নতুন সানলাইট ব্যাটারিগুলোর মুখে লাগানো প্লাস্টিকের ছোট্ট ক্যাপটি ভুলবশত না-খুলেই লাগিয়ে দিয়েছেন, তাই চলছে না! এবার তার মাথায় এল দুষ্ট বুদ্ধি। সে বললো, জটিল বেমার, বিমানের ঝাঁকুনিতে রেকর্ডারের নাড়িবুড়ি ওলটপালট হয়ে গেছে, সারাতে এক দিন লাগবে, টাকাও লাগবে অনেক। আগামীকাল বিকেলে এসে নিয়ে যাবেন। রেকর্ডার ঠিক হওয়ার নিশ্চয়তাও দিল। টাকা যা লাগে লাগুক—রেকর্ডার তার ঠিক হওয়া চাই; এ বলে প্রবাসী বাড়ি ফিরলেন।

রাতের এক সময়ে সে মেকার দাঁত দিয়ে টান মেরে ব্যাটারির ক্যাপগুলো খোলে দিল, তারপর রাতভর মন ভরে নানাসুরের নানান গান শুনলো। আটশো টাকার কন্ট্রাক্ট হজমের আনন্দে রেকর্ডারের ফুল ভলিউম দিল ছেড়ে (তখনকার ৮শো টাকা আজকের ১০হাজারের চেয়ে বেশি)। 

পরদিন প্রবাসী ফিরলেন, রেকর্ডার ঠিক হয়েছে দেখে অতিরিক্ত বকশিসও দিলেন।

এই দীর্ঘ গল্পের মতো কানাডার ভিসার মুখে লাগানো ক্যাপগুলো খুলতে না পারায় দালালদল হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি-কোটি টাকা। গতকাল সন্ধ্যায় এক দালাল তার খদ্দেরকে বলছে, আগের এম্বেসেডর বদল হয়ে নতুন এক নারী এম্বেসেডর এসেছে! এই নারী নাকি আবার বদমেজাজি, কোনোভাবেই কাবু হচ্ছে না। তবে, তার সাথেও আলোচনা চলছে, বেশি টাকা চাইছে সে, এজন্য একটু দেরি হচ্ছে। ক্লায়েন্টকে একটু ধৈর্য ধরতে বলছে!!

আমি শুনে বললাম, মুখে জুতা দিয়ে বাড়ি দিলে না কেন! এম্বেসেডর ভিসা ইস্যু করে আর টাকা দিয়ে তাকে কেনা লাগে—এ কথা বলতে নূন্যতম লজ্জাও করল না! করাপ্টেড রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাস করত-করতে মাথায় ৩২নাম্বারি চিন্তা ছাড়া আর কিছু আসে না! ঐ দালালকে বলো, তাহলে তোমার পাসপোর্ট ১৫ বছরের জন্য একটি এম্বেসি ব্ল্যাকলিস্টেড করে রাখল কেন?

প্রিয় বিদেশগামী নবীন প্রজন্ম, একটু ঘাটাঘাটি করুন, লেখাপড়া করুন, কারও হাতে জমি বিক্রির টাকা তোলে দেয়ার আগে একটু খোঁজখবর নিন।



শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়