Tuesday, November 11

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাতিঘর বায়তুল-হিকমা


এম এ নাছের শতাব্দীকাল ধরে সংগৃহীত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য রত্নভান্ডার এবং মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির তীর্থ কেন্দ্র বায়তুল-হিকমা নবম শতাব্দীর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণাগার, গ্রন্থাগার এবং অনুবাদশালা, যা থেকে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি একটি স্বর্ণযুগে উপনীত হয় এবং জন্ম হয় এ সভ্যতার অগাস্টান যুগ। আব্বাসীয় খলিফা হারুন-উর-রশীদের ছেলে খলিফা আল-মামুনের রাজত্বকালে বায়তুল-হিকমা চরম উৎকর্ষ লাভ করে। ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ইরাকের বাগদাদে বায়তুল-হিকমা নামে এক অদ্বিতীয় গবেষণাগার, অনুবাদ কেন্দ্র বা গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন খলিফা আল-মামুন। খলিফা হারুন-উর-রশীদ এর শাসনামলে (৭৮৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ) বায়তুল-হিকমা জন্মলাভ করলেও এর প্রকৃত বিকাশ সাধিত হয় খলিফা আল-মামুনের সময়। এ জগৎখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির ছিল তিনটি বিভাগ। ক. গ্রন্থাগার খ. শিক্ষায়তন গ. অনুবাদ ব্যুরো। হুনাইন-ইবনে-ইসহাক ছিলেন বায়তুল-হিকমার মহাপরিচালক। ঐতিহাসিক আমীর আলী খলিফা মামুনের রাজত্বকে নিঃসন্দেহে ইসলামের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ও গৌরবময় যুগ বলে অভিহিত করেছেন- যার গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক ছিল বায়তুল-হিকমা। এখানে গ্রিক, সিরীয়, পারসিক, ভারতীয়, আরবীয়, খ্রিস্টান প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ের মনীষী ও পন্ডিতরা শিক্ষামূলক গবেষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, অনুশীলন ও অনুবাদ কাজে নিয়োজিত থাকতেন। খলিফা আল-মামুন বিভিন্ন অঞ্চল এবং রাজ্য থেকে দূত পাঠিয়ে কিংবা প্রতিনিধি মারফত নানা দেশের জ্ঞান ভান্ডারে সঞ্চিত পুস্তকের পান্ডু লিপি সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। প্রথমদিকে পারসিক এবং খ্রিস্টান পন্ডিতরা প্রাচীন গ্রিসের সংগৃহীত সব বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। এ অনুবাদ আন্দোলনের কার্যক্রম খলিফা মামুনের সময় এরিস্টটলের 'টপিকস' অনুবাদের মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে শুরু হয়। অনুবাদকরা পারসিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূল্যবান গ্রন্থগুলো অনুবাদ করেন। এখানে পিথাগোরাস, প্লেটো, ইউক্লিড, এরিস্টটল, হিপোক্রেটিস, প্লোটিনাস, গ্যালেন, সুশ্রুতা, চারাকা, আর্যবাতা, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখের বিভিন্ন রচনার অনুবাদ হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, নবম শতকের মধ্যভাগে বায়তুল-হিকমাহ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গ্রন্থ ভা-ার। বায়তুল-হিকমার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়াদের পরাজিত করে আব্বাসীয়রা ক্ষমতা দখল করে এবং রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে স্থানান্তর করে যেখানে বহুজাতিক চিন্তা ও মুক্ত মনের কর্মকান্ডের জন্য এ সুসংহত কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। বায়তুল-হিকমা একটি একাডেমিক কেন্দ্রের চেয়েও বেশি গুরুত্ববহ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এর বিশেষজ্ঞরা বাগদাদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হন; আল খারেজমি বায়তুল-হিকমায় কর্মরত অবস্থায় বীজগণিতের ওপর ব্যাপক অবদান রাখেন। তার গ্রন্থ কিতাবুল জাবেরের জন্য তিনি এ সময় কিছু এলগরিদম উদ্ভাবন করেন। আল খারেজমি ভারতীয় দশমিক পদ্ধতির সঙ্গে আরব বিশ্ব এবং ইউরোপীয়দের পরিচিত করেন। মোহাম্মদ মুসা ইতিহাসে সর্বপ্রথম পদার্থবিদ্যার সূত্রের সার্বজনীনতা প্রমাণ করেন। দশম শতকে ইবন আল-হাইসাম (আলহাজেন) শরীরবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ে সফল পরীক্ষা করেন। যার মধ্যে অধিকাংশ ছিল চক্ষুবিষয়ক, যা বর্তমান সময় পর্যন্ত সমাদৃত। দুই ভাই আহমদ এবং হাসানসহ মোহাম্মদ মুসা 'বুক অব ইনজেনিয়াস ডিভাইসেস' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে ১০০টি যন্ত্র ও সেগুলোর ব্যবহারবিধি বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে বর্ণিত 'দ্য ইন্সট্রুমেন্ট দ্যাট প্লেইস বাই ইটসেলফ' ডিভাইসটি প্রথম প্রোগ্রামেবল মেশিন। আল কিন্দি তথ্যের গোপনীয়তাবিষয়ক ক্রিপোটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেন। এছাড়াও জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়। বাইতুল-হিকমার পন্ডিতরা ৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মানমন্দির নির্মাণ করেন, যা আল শামাসিয়ায় অবস্থিত ছিল। যাকে মুমতাহান মানমন্দির বলা হতো। আল-মামুনের উত্তরাধিকারী আল মুতাসিম (৮৩৩-৮৪২ খ্রিস্টাব্দ) ও তার পুত্র আল ওয়াসিকের অধীনে বায়তুল হিকমা তার সৌকর্য বজায় রাখে। কিন্তু আল মুতাওয়াক্কিলের আমলে এর অবনতি শুরু হয়, যার চূড়ান্ত ধ্বংসসাধন হয় হালাকু খান কর্তৃক ১২৫৮ সালে বাগদাদ নগরী ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়