হজের বাতাস বইতে শুরু করেছে। মোবারক দিনগুলোর আগমন ঘটেছে। হ্যাঁ, এরা হাজী এবং যারা এখনও নিজেদের দেশ থেকে হজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তারাও। আগ্রহ তাদের তাড়িত করছে এবং প্রাচীন-গৃহ-আলিঙ্গনের স্বপ্নগুলো তাদের তাড়া করছে। অনুভূতিগুলো পবিত্র ভূমির দিকে হৃদয়কে ধাবিত করছে, অন্তর ভরে দিচ্ছে ব্যথায়, যা আত্মাকে বিদ্ধ করছে এবং কলবকে বদ্ধ করছে। তৈরি করছে আশা ও আশঙ্কা, প্রত্যাশার অনিশ্চয়তা এবং আগ্রহ ও আকর্ষণের ভালোবাসার মিশ্র আবেগ।
আল্লাহর সম্মানিত ঘর সফরের সিদ্ধান্ত নেয়া থেকেই হৃদয়-মন আবেগ-ব্যাথায় আন্দোলিত হচ্ছে। মূর্ত হয়ে উঠছে মক্কা ও এর পবিত্র স্থানগুলো। মদিনা ও এর নূরানি জায়গাগুলো। ভাবনা ছুটছে সুদূর অতীতে। দৃশ্যমান হয়ে উঠছে কোরাইশ ও তাদের নিদর্শনাবলি এবং প্রথম দাওয়াত ও এর তাৎপর্যগুলো। জায়গাগুলোর স্মৃতিচারণ শান্ত হৃদয়কে করে তরঙ্গায়িত। সুপ্ত বাসনাগুলো করে উদ্দীপ্ত। আর এসবের স্মৃতিচারণই সংশ্লিষ্ট স্মৃতি ও ঘটনাবলির প্রতীক।
কাবা ও পবিত্র হারাম, হেরা, জমজম ও মাকামে ইবরাহিম, গারে ছাওর ও খাইফু মিনা, আরাফা উপত্যকা, মসজিদ নামিরা, বাতনে সাফা, দারুল আরকাম, মাশআরে হারাম, শামা ও তাফিল, মুজদালিফা ও ছাবির, হিররা ওয়াকিম, বনু সালেম বিন আউফ, মসজিদে কুবা, আরিছ কূপ, ওহুদ পাহাড়, জান্নাতুল বাকি, নবী (সা.) এর ঘর ও তাঁর মিম্বরের মধ্যস্থিত রওজা এবং খন্দকের নিদর্শনাবলি প্রভৃতি_ মক্কা এবং মদিনার এসব নামের প্রতিটিই আপনার হৃদয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় যখনই নামগুলো স্মরণ করেন। যখনই আপনার চিত্ত এসবের পরিদর্শন ও দর্শন কামনা করে। যখনই আপনি এসব স্থানে ঘটে যাওয়া মহান মহান ঘটনা কল্পনা করেন তখন গোপন কান্নারা ভিড় করে। আনন্দের অনুভূতির উষ্ণতা প্লাবিত হয়। ইসলামের জীবন্ত ইতিহাসগুলো অন্যমনস্ক করে আমাদের। কী সেই মহামুহূর্তগুলো! কী সেই মানবতার মর্যাদা বাড়ানো বিজয়ের দৃশ্যগুলো!
নবী (সা.) লোকজন নিয়ে ২৫ জিলকদ শনিবার বাদ জোহর বের হন। তখন তাঁকে কেন্দ্র করে সমবেত হয় লক্ষাধিক হাজী। জাবের (রা.) সেই ভীতিজাগানিয়া উপস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন, 'রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে নামাজ পড়লেন। অতঃপর কাসওয়ায় (উটের নাম) আরোহণ করলেন। তারপর যখন মরু প্রান্তরে তাঁর উটনি গিয়ে উপনীত হলো, আমি দৃষ্টির দিগন্তে নজর প্রসারিত করলাম। তাঁর সামনে আরোহী ও পদব্রজী, তাঁর ডানেও তেমন, বামেও তেমন এবং পেছনেও তেমন। আর রাসূল (সা.) আমাদের মাঝে...।' (মুসলিম)। এ মহাউপস্থিতি যেন মহান আল্লাহর বাণীরই ভাষান্তর, 'তিনিই তোমাকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর সাহায্য ও মোমিনদের দ্বারা।' (সূরা আনফাল : ৬২)।
আর হিজরতের আগের সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন তিনি বিভিন্ন গোত্রের কাছে ঘুরে ফিরছিলেন এ কথা বলে, 'কে আমাকে আশ্রয় দেবে আমি যাতে আমার রবের রেসালত পেঁৗছাতে পারি, তার বিনিময় হবে জান্নাত?!' তখন তিনি নিজ দাওয়াতে কোনো সাড়াদাতা খুঁজে পাননি, পাশে কোনো সাহায্যকারী খুঁজে পাননি। কিন্তু আজ তারা তাঁর কাছে ছুটে এসেছে প্রতিটি প্রান্ত থেকে। স্মরণ করিয়ে দেয় সেদিনের কথা যখন তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে বিতাড়িত হয়ে বেরিয়ে যান। তখন তাঁর সঙ্গে সিদ্দিক (রা.) ছাড়া আর কেউ ছিল না। আর আজ দৃষ্টিসীমা অবধি লোকে লোকারণ্য। লোকে তাঁকে ঘিরে আছে এবং তাঁর উটের রেকাবিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কত সত্য দেখুন, 'আর মোমিনদের সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য।' (সূরা রুম : ৪৭)।
আমরা যেন এখন বিদায় হজে দেয়া নবী (সা.) এর শাশ্বত খুতবা শুনতে পাচ্ছি। সেদিন তিনি যা সাহাবিদের জন্য, আমাদের জন্য এবং আমাদের পরবর্তীদের জন্য বলেছিলেন তার মধ্যে ছিল, 'নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ হারাম ঘোষণা করা হচ্ছে। অতএব আমার পর তোমরা কুফরি অবস্থায় ফিরে গিয়ে একে অপরের ঘাড়ে আঘাত করবে না। আর জাহেলি যুগের সুদ রহিত করা হলো। আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালা হলো কোনো সুদ থাকবে না। আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদেরও অধিকার রয়েছে স্ত্রীদের ওপর। তোমাদের সবার রব এক। তোমরা প্রত্যেকেই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে তৈরি।' 'তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন।' (সূরা হুজুরাত : ১৩)'।
আরবি থেকে ভাষান্তর : আলী হাসান তৈয়ব
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়