Thursday, December 27

জনগণের ক্ষমতায়ন হলেই রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে



রায়হান আহমেদ তপাদার:
রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে শক্তিশালী করতে হলে জনগণকে ক্ষমতায়িত করার এবং প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে আজ জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের শক্তির মূল উৎস এর জনগণ ও প্রতিষ্ঠান

রাষ্ট্র হিসেবে একটি ভূখ-ের পূর্ণতা লাভ করার জন্য অনেকগুলো জরুরি পদক্ষেপ আবশ্যক। এসব পদক্ষেপের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জনগণের ক্ষমতায়ন। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এ দুটি মৌলিক পদক্ষেপের ফলে রাষ্ট্র শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়, পূর্ণতা লাভ করে এবং শক্তিশালী হয়। দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার পর ৪৭ বছরেও এ দুটি মৌলিক পদক্ষেপ আমাদের দেশে বহুলাংশে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা উল্টোদিকে হেঁটেছি, ফলে আমরা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে আজও পরিণত হতে পারিনি।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে নির্বাচন। একটি দেশ যত বেশি গণতান্ত্রিক হবে, নির্বাচনে তত বেশি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে।
নির্বাচনে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সরল অর্থ হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, সব দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ায় সমান সুযোগ ভোগ করবে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, দেশে নির্বাচনি প্রতিযোগিতার জন্য একটি সমতল মাঠ বা লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড থাকবে। এ মাঠে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলো সমান সুযোগ নিয়ে তাদের নির্বাচনি প্রচার কার্যক্রম চালানোর সুযোগ পাবে। দলগুলো জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য অবাধে তুলে ধরতে পারবে। কোনো দল এক্ষেত্রে কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়বে না। আবার কোনো দল অবৈধভাবে বেশি সুযোগ পাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেই সমতল মাঠের অস্তিত্ব নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোকÑ এই দাবি দেশ-বিদেশের নানা মহল থেকে বারবারই উত্থাপিত হয়ে আসছে।
কিন্তু নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংশয়-শঙ্কা সংগত কারণেই জিইয়ে ছিল। প্রশ্ন ছিল, শেষ পর্যন্ত তা কতটা পূর্ণতা পাবে। এ ধরনের প্রশ্নের প্রেক্ষাপট ক্ষণে ক্ষণেই তৈরিও হচ্ছিল সরকারের নানা ধরনের প্রতিশ্রুতির পরও। তবে শেষ পর্যন্ত এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে যে বিষয়গুলো থাকা উচিত, বিগত সরকারের সব নৈতিক কাজের স্বীকৃতি প্রদান। প্রয়োজনে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা গ্রহণ। তাদের অসম্পূর্ণ নৈতিক কাজগুলো সম্পূর্ণকরণ। যে-কোনো নতুন কাজ করার আগে জনগণের মতামত গ্রহণ। এমন কোনো কাজ না করা, যা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে কারও মনে আঘাত দেয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কল্যাণকর বিভিন্ন কাজের উদ্যোগ গ্রহণ।
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন। যোগাযোগব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন। প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার। বিরোধী দলকে অন্যায়ভাবে দমন না করার প্রতিশ্রুতি। সব সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ মিলে একত্রে দেশের উন্নয়নে কাজ করার ব্যবস্থা। সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি।
সরকারের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর শতভাগ রাজনৈতিক এবং নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রদান। স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ পরিহার করে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বিভিন্ন পদে পদায়নকরণ। সব কাজে জনগণের মতামতের প্রতিফলন। গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও ক্ষমতায় গেলে করণীয় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার খসড়া তুলে ধরা হয় নির্বাচনি ইশতেহারে।
দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। অন্যদিকে হাতেগোনা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ইশতেহার এত ধারা ও উপধারায় বিভক্ত থাকে যে, সাধারণ জনগণ তাতে নজর দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না। এছাড়া গণমানুষের প্রত্যাশা থাকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতাদর্শগত বিশেষজ্ঞ কমিটি; যে কমিটিতে থাকবেন এক বা একাধিক প্রথিত অর্থনীতিবিদ, কৃষিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, সংস্কৃতিবিদ, ক্রীড়াবিদ, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসাবিদ, সমরবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, ধর্মীয় গুরুজনসহ সংশ্লিষ্টরা। জনগণের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ বিনোদনের সব সুযোগ সৃষ্টির পদক্ষেপ চাই। উন্নত বিশ্বে ক্ষমতায় আরোহণের প্রথম শত দিনে ক্ষমতাসীন দল কী কী পদক্ষেপ নেবে, তারও ফিরিস্তি প্রকাশ করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর বাস্তবভিত্তিক ও যুযোপযোগী নির্বাচনি ইশতেহার এবং তার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকতে হবে। নির্বাচনি ইশতেহারে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সামনে কিছু অঙ্গীকার তুলে ধরে। সাধারণ মানুষ এসব অঙ্গীকার দেখে ভোট দেয়। কিছু গতানুগতিক প্রতিশ্রুতি সবসময় দেওয়া হয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাধারণ মানুষের চাহিদা ও আকাক্সক্ষার কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আমরা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর এলাকার লোক হওয়া সত্ত্বেও আমরা সারা বছর লোডশেডিংয়ের সমস্যায় ভুগী। পুরান ঢাকায় কিছু গ্যাস পাওয়া গেলেও কেরানীগঞ্জবাসী গ্যাস থেকে বঞ্চিত।
নির্বাচনি বাতাস বইতে শুরু করায় আমরা কিছু গ্যাস পেতে শুরু করেছি। সবার আর্জি, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও যেন এ গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকে।
শিক্ষিত বেকাররা দেশের বোঝা। তাদের জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে আরও জোরালো ভূমিকা চাই। অযোগ্য, অসৎ মানুষকে বিতাড়িত করে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ক্ষমতায় আনলে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা রক্ষা করা সম্ভব। দলবদল নয়, দিনবদলের সময় এখন। জনগণ গতানুগতিক ইশতেহার নয়, ভিন্নধর্মী নির্বাচনি ইশতেহার চায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল ইশতেহার প্রকাশ করে থাকে। নির্বাচন-পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনা কীভাবে করা হবে তার রূপরেখা হলো নির্বাচনি ইশতেহার। আমার মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো থাকলে ভালো হয়Ñ বিরোধী দল থেকে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, জাতীয় সংসদকে সব নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা, কোনো সংসদ সদস্য জনগণের সম্পদ চুরি বা চুরি করতে সাহায্য করলে অথবা অবৈধ কর্মকা-ে জড়িত থাকলে দল ও সংসদ থেকে বহিষ্কার করে সংসদের পবিত্রতা রক্ষা করাÑ সর্বোপরি সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের আলোকে সংসদ সদস্যদের ও প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি শাসন থেকে আমরা কাগজে-কলমে মুক্তি পেলেও তাদের সৃষ্ট শাসন কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। তাই দরকার নির্বাচনি পদ্ধতিকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে নির্বাচনের ব্যয় হ্রাস ও সন্ত্রাস বন্ধ করা।
এছাড়া দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক, ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলা, যারাই জনগণের সম্পদের অপচয়কারী হিসেবে চিহ্নিত তাদের প্রার্থী করা থেকে বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। মেয়াদ শেষে প্রার্থীর আয়-ব্যয়ের ও সম্পদের বিবরণ জনগণের কাছে প্রকাশ করা; দুবারের বেশি যাতে কেউ কোনো দলের প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা করা; সৎ, দক্ষ, গণমুখী, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কার্যকরী প্রশাসন গড়ে তোলা; তাদের কর্মকা-ের জন্য জনপ্রতিনিধির কাছে দায়বদ্ধ থাকার ব্যবস্থা করা এবং গুরুত্বপূর্ণ অফিসে কর্মকা-ের তদন্ত করে শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করা। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার প্রতিফলন তাদেরই ঘটাতে হবে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে আবহের দরকার, তা নিশ্চিত হোক। বাংলাদেশের জনগণ বরাবরই উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, আপনারা যে যেখানে থাকুন না কেন আপনাদের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ আসছে আগামী ৩০ ডিসেম্বর। ডিসি, এসপি, ম্যাজিস্ট্রেট, ওসি তো বটেই, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে নির্বাচন কমিশন নানা ধরনের নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত করবে। কোনোটা বড় দায়িত্ব, কোনোটা অপেক্ষাকৃত ছোট দায়িত্ব; কিন্তু সবটাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এতে অসম্মতি জানানো যাবে না। কারণ নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর থেকে সাংবিধানিকভাবে প্রশাসনিক বস নির্বাচন কমিশন।
উল্লেখ্য, ওই দিনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি যদি সুচারুরূপে অনুষ্ঠিত হয়, যদি কোনো অন্যায় প্রশ্রয় না পায়, তাহলে মনে রাখবেন, সে সাফল্যের বড় দাবিদার হবেন আপনারা। একটি সফল নির্বাচন হবে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার পথে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করার পথে একটি বিরাট পদক্ষেপ। বিশ্বাস করুন, দেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে। সব দলের অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু পক্ষপাতহীন একটি ভালো নির্বাচন বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় সব মানুষের আজ প্রাণের দাবি। আপনারা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিশ্চয়ই তাদের নিরাশ করবেন না। উপরি-উক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, একটি ঘোষণা ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলেও ৪৭ বছরে এটিকে আমরা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারিনি। আমরা দেশের সাধারণ জনগণকে প্রজা থেকে নাগরিক তথা মালিকের আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারিনি। তাদের চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে রাষ্ট্র গড়ার কারিগরে পরিণত করতে পারিনি। একই সঙ্গে ৪৭ বছরে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও শক্তিশালী করার পরিবর্তে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর, এমনকি ধ্বংস করার মহোৎসবে আমরা লিপ্ত হয়েছি। একমাত্র নির্বাচন কমিশনই গত দুই বছরে কিছুটা শক্তি ও গতিশীলতা অর্জন করেছে; কিন্তু পরিপূরক ও সহায়ক প্রতিষ্ঠানের অভাবে এটির ভবিষ্যৎও ঝুঁঁকিপূর্ণ হতে বাধ্য। তাই রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে শক্তিশালী করতে হলে জনগণকে ক্ষমতায়িত করার এবং প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে আজ জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের শক্তির মূল উৎস এর জনগণ ও প্রতিষ্ঠান। 
 রায়হান আহমেদ তপাদার
লেখক ও কলামিস্ট


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়