Saturday, February 28

মানুষের অধিকার সংরক্ষণে ইসলাম


এইচ এম আবদুর রহিম: ইসলাম এমন এক সর্বজনীন ধর্ম, যেখানে সব মত, পথ ও ধর্মের সহাবস্থানের বিধান রয়েছে। ইসলাম দেড় হাজার বছর ধরে উদারতা, মানবিকতাবোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার। বাণী প্রচার করে আসছে। এতে বিশ্বব্যাপী ইসলাম জীবন্ত এক জীবনাদর্শ রূপে বহু জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত সমাজে নিজের ভিত মজবুত করতে সম হয়েছে। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী সা: মদিনায় হিজরত করে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের নিয়ে যে চুক্তি করেন, তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত এ সংবিধানে স্পষ্টই উল্লেখ আছে, ‘প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। ধর্মীয় ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অপরাধের জন্য ব্যক্তি দায়ী হবে, সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না। মদিনা প্রজাতন্ত্রকে পবিত্র ঘোষণা করা হলো। রক্তপাত ও জুলুম নিষিদ্ধ করা হলো।’ কোনো ধর্মকে কটা, অপমান ও ব্যঙ্গ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ইসলামে জায়েজ নেই। কোনো ইমানদার ব্যক্তি অমুসলিমদের উপাসনালয়ে হামলা করতে পারে না।বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা ও সদ্ব্যবহার ইসলামের অনুপম শিক্ষা। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা আমাদের প্রতিবেশী। আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা পবিত্র কুরআনের নির্দেশ। মূর্তি ও প্রতিমা ভাঙচুর করা তো দূরের কথা, তাদের গালি ও কটাক্ষ না করার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুম রয়েছে। মহানবী সা:-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনে অমুসলিমদের উপসনালয়ে আক্রমণ বা তাদের বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার হুকুম দিয়েছেন, এমন কোনো নজির ইতিহাসে নেই। রাষ্ট্রদ্রোহী ও সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় এনেছেন। সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম ইসলামে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। ইসলামের শাশ্বত আদর্শ প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে আলেমসমাজ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। রাজনীতি, ধর্ম ও অর্থনীতিসহ নানা কারণে সন্ত্রাস হয়। সন্ত্রাস সমাজের জন্য একটি ভয়াবহ ক্যানসারের মতো। তাই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদরোধে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। আমরা ভুলে যাই, ব্যক্তির অপরাধের জন্য সম্প্রদায় দায়ী নয়। ইসলামকে কোনো না কোনোভাবে কটাক্ষও ব্যঙ্গ করা একশ্রেণীর লোকের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে; হোক সেটা বিদ্যালয়ের কাসে, ফেসবুকে, ব্লগে বা সংবাদপত্রের পাতায়। এদের লাগাম টেনে ধরতে হবে এখনই। আমরা ধ্বংস দেখতে চাই না, শুনতে চাই না বিপন্ন মানুষের করুণ আর্তনাদ। ধর্ম, ধর্মীয় গ্রন্থ ও ধর্মীয় উপাসনালয় অবমাননার অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর ৭০ কোটি মানুষের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শ এক নয়। নিজ নিজ ধর্মের প্রচার ও যৌক্তিকতা ভিন্ন মতাবলম্বীদের কাছে তুলে ধরতে কোনো দোষ নেই। যৌক্তিক ও বাস্তব মনে না হলে সে মতাদর্শ প্রত্যাখ্যান করার অধিকার সবার আছে। তবে অপরের লালিত বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার হীন প্রচেষ্টা অপরাধ; আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে তা সন্ত্রাস। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে এ ধরনের অপচেষ্টা মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী। আর ইসলামে মানবাধিকার অত্যন্ত বিস্তৃত। শুধু মানুষ কেন, সমগ্র সৃষ্টিরই অধিকার রয়েছে সদাচরণ পাওয়ার। বৃ-লতারও অধিকার আছে যে, অহেতুক কেউ তার ডাল-পাতা ছিঁড়বে না বা ভাঙবে না। যে পশুকে জবেহ করে আমরা গোশত খাই, তারও অধিকার হলো ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে তাকে জবেহ করতে গিয়ে কষ্ট দেয়া হবে না, ভারবাহী পশু হলে তাকে তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত বোঝা দেয়া যাবে না, যা বহন করা তার জন্য কষ্টকর বা কোনো পশুপাখিকে আটকে রেখে তাকে কষ্ট দেয়াও গুনাহের কাজ। মালিক-শ্রমিক ও মনিব-ভৃত্যেরও পারস্পরিক কিছু অধিকার ও কর্তব্য রয়েছে। মালিকের অধিকার হলো তার অধীন শ্রমিক-কর্মচারীরা পূর্ণ দায়িত্বানুভূতির সাথে কাজ করবেন। মালিকের কাছ থেকে সময়মতো ন্যায্য পারিশ্রমিক নেবেন আর দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবেন- এটা কখনোই হতে পারে না। যারা নেয়ার সময় পুরোপুরি নেবেন আর দেয়ার সময় কম দেবেন- এমন লোকেদের জন্য রয়েছে ধ্বংস (সূরা আল মুতাফ্ফিহিন)। শ্রমিকের অধিকার রয়েছে যে, মালিক তাকে ন্যায্য পারিশ্রমিক দেবেন ও উত্তম আচরণ করবেন। মানুষের অধিকার সংরণের জন্য মানুষ সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা। রাষ্ট্র অনেক সময় তাকে নিরাপত্তা দিয়েছে, আবার অনেক স্বৈরশাসক রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে। মানুষ বেশির ভাগ রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে এবং এর থেকে পরিত্রাণের জন্য অনেক ত্যাগও স্বীকার করেছে। মানুষের কাজের জন্য স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতা ও আখেরাতের বদলাকে অস্বীকৃতিই এসব সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের কারণ। আল্লাহ তায়ালা প্রেরিত সব নবী-রাসূলকে সমসাময়িক রাজশক্তি মোটেই সহ্য করতে পারেনি এবং সবাই তাদের অস্তিত্বের জন্য নবী-রাসূলকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেছে। বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের ভাষায় বলা যায়, সব নবী-রাসূলই রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে এসেছেন। নমরুদের বিরুদ্ধে ইবরাহিম আ:, ফেরাউনের বিরুদ্ধে মুসা আ:, আবু জেহেল-আবু লাহাবদের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদ সা:- এই হলো ইতিহাস। নমরুদ-ফেরাউন-আবু জেহেলের অনুসারী বনাম ইবরাহিম আ:, মুসা আ:, মুহাম্মাদ সা:-এর অনুসারীদের মধ্যে এ দ্বন্দ্ব চিরন্তন। সব বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে রাসূল সা: ইসলামকে একটি রাষ্ট্রীয় দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন। রাসূল সা: প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই ছিল যথার্থ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। তিনিই প্রথম ধারণা দিলেন রাষ্ট্র বা সরকার উৎপীড়ক নয়, জনগণের অধিকার সংরণই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জনগণের জান-মাল-সম্মানের পূর্ণ নিরাপত্তাদান রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ। মক্কায় বসে তিনি এমনই স্বপ্ন দেখতেন এবং মক্কার কঠিন সময়ে যখন তাঁর সঙ্গীসাথীরা দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়তেন, সে সময় তিনি আশার বাণী শুনিয়েছিলেন এই বলে- ‘সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন একজন ষোড়শী স্বর্ণালঙ্করসহ সানা থেকে হাজরা মাওত একাকী হেঁটে যাবে, তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে আরব-অনারব, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, মনিব-ভৃত্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনো ভেদাভেদ ছিল না; একটিই পরিচয় ‘তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরী। সমাজ তিগ্রস্ত হয় বা কোনো না কোনোভাবে মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন হয়, এমন সব কাজকে তিনি নিষিদ্ধ (হারাম) ঘোষণা করেন। তিনি সমাজে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন এবং সন্দেহবশত কাউকে হয়রানি ছিল সে সমাজে অকল্পনীয়। শাসন ও বিচারকাজ পরিচালনায় তিনি ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো আশ্রয় থাকবে না, সেই কঠিন মুহূর্তে আরশের ছায়ার নিচে আশ্রয়প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হবেন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী বিচারক। আবার তিনি হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন এই বলে- যে শাসক জালেম ও খিয়ানতকারী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে, আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। তিনি বলেন, যে বিচারক সত্যকে জানতে পেরেও ফায়সালা করার ব্যাপারে অবিচার ও জুলুম করেছে সে জাহান্নামে যাবে। আর যে অজ্ঞতা সত্ত্বেও জনগণের জন্য বিচার ফয়সালা করেছে সেও জাহান্নামি হবে। বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থীরা সর্বপ্রকার মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং তাদের ওপর সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে। যে রাষ্ট্রযন্ত্র তার নাগরিকদের জুলুম থেকে রা করবে, সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে জুলুমের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওদের অপরাধ হলো আল্লাহর ভাষায় ‘ওরা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে’ (সূরা বুরুজ)। যেকোনো বিচারে ঈমানদারেরা নীতি-নৈতিকতা, আচার-আচরণ, অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন ও ব্যবসায়িক লেনদেনে সর্বোত্তম ব্যক্তি। ইসলামে বিশ্বাস ও তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টাই তাদের অপরাধ। নেশার জগতে ওরা দাবি করে যে, তারা শতভাগ নেশামুক্ত। আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাহদের ওপর জুলুম কখনোই সহ্য করেন না। সাধারণত তিনি শাস্তিদানের জন্য তাড়াহুড়ো করেন না, তিনি তাঁর বান্দাহর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন যে, সে ফিরে আসে কি না। আল্লাহ বলেন, যারা কুফরি করেছে এবং আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিয়েছে, আল্লাহ তাদের সব কাজকর্ম ব্যর্থ করে দিয়েছেন (সূরা মুহাম্মদ)। তিনি আরো বলেন, যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের ওপর জুলুমপীড়ন চালিয়েছে, তারপর তা থেকে তওবা করেনি, নিশ্চিতভাবে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব এবং জ্বালাপোড়ার শাস্তি। আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাগান, যার নিম্নদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত। এটিই বড় সাফল্য (সূরা বুরুজ, ১০-১১)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়