Thursday, November 6

মোবাইল ফোনে যৌন ফাঁদ


কলকাতা প্রতিনিধি : নির্দিষ্ট কোন ফোন নম্বর বা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি নয়, ফোন নম্বর হলেই হলো। সেই ফোন নম্বরে অনবরত মিস কল। তারপর সেই মিসড কলের প্রত্যুত্তরে কোনো পুরুষ ফোন করলে তাঁর সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব। পরে মিথ্যে প্রেমের ফাঁদে ফেলা। শেষে নিজেকে বাপ-মা হারা অসহায় বলে পরিচয় দিয়ে বরফটিকে গলিয়ে পানি করে ফেলা। এতটা পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু এর পরেই আসছে ‘কাহানিমে টুইস্ট’। শুরু সিনেমার মত আসল গল্প। ভাগ্যচক্রে লেগে যাওয়া মিসড কলে, ব্যক্তিকে না চেনা সত্ত্বেও, নারী হয়ে পড়েন আবেদনময়ী। এখানে নারীর উদ্দেশ্য খুবই পরিস্কার। পুরুষ বন্ধুটির সঙ্গে উপযুক্ত কোনও স্থানে দৈহিক সম্পর্ক করে সেই দৃশ্য বা কথোপকথন রেকর্ড করে তা নিয়ে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল। নিত্য নতুন খদ্দের ধরে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার মাধ্যমে দামি মোবাইল সেট, সোনার আংটি, চেইন ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। পশ্চিমবঙ্গে এভাবেই জেলায়-জেলায় জমে উঠেছিল মিসড কল রহস্য। খুব সহজেই চলতে থাকত ব্ল্যকমেইলিং ব্যবসা, যদি বালুরঘাট শহরের বেসরকারি ব্যাঙ্কের ছাদ থেকে পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে না নামত পুলিশ। আর তদন্তে নেমে এমনই এক সক্রিয় চক্রের সন্ধানে বড়সড় সাফল্য পেল রাজ্য পুলিশ। পুলিশ সূত্র জানায়, বেসরকারি ব্যাঙ্কটির সিকিউরিটি গার্ডই এই চক্রের মূল হোতা। জেলার গ্রামীণ গরীব মহিলাদের নিয়ে এই চক্রটি গড়ে তোলা হয়। মিসড কলের মাধ্যমে বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কাজে চক্রের নারীদেরকে লাগানো হয়। গত শনিবার রাতে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরে রথতলা এলাকায় অবস্থিত ব্যাঙ্কের ছাদ থেকে পড়ে যান বিজন সরকার। মোবাইল টেলিফোনে আলাপের মাধ্যমে তাকে ফাঁসানো হয়। টোপ দিয়ে তাকে ব্যাঙ্কের ছাদে ডেকে নিয়ে এই চক্রের এক মহিলা দৈহিক সম্পর্ক শুরু করে। পরিকল্পনা মাফিক নাটকীয়ভাবে সেখানে গিয়ে হাজির হয় চক্রের মূল হোতা ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড মানজারুল সরকার। এর পরেই শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল করার পর্ব। মহিলাকে নিজের বউ পরিচয় দিয়ে পুলিশে খবর দেওয়া বা পরিবারের লোকেদের জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বিজন সরকারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে তারা। তা দিতে রাজি না হলে শুরু হয় মারধর ও ধাক্কাধাক্কি। ঘটনার পরবর্তী ফলাফল বিজন সরকারের মৃত্যু। পুলিশ তদন্তে নেমে সেদিন রাতে ছাদ থেকে উত্তেজনাবর্ধক ট্যাবলেটের খোসা ও আই-পিল উদ্ধার করে। যা থেকে পুলিশের সন্দেহ হয় যে, এর পেছনে বড় কোনো ঘটনা লুকিয়ে আছে। আর তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ। এই ঘটনায় ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড এবং মর্জিনা খাতুন নামের এক মহিলাকে গ্রেফতার করেছে বালুরঘাট থানার পুলিশ। তারা স্বীকার করেছে যে, শুধু বিজন সরকারকেই নয়, একই কায়দায় এর আগে বহু পুরুষকেই তারা ব্ল্যাকমেইল করে প্রচুর টাকা ও জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, এই চক্রের সঙ্গে কুমারগঞ্জ এলাকার আরো কয়েকজন মহিলা জড়িত রয়েছে। মানজারুলের নির্দেশে যারা মোবাইল ফোনে মিস কল দেয়, এক পর্যায়ে পুরুষদের সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব ও পরে দৈহিক সম্পর্ক করে ফাঁসিয়ে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে। পুলিশ তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও, সেই সঙ্গে ব্ল্যাকমেইল করার সময় কথোপকথনের রেকর্ডও উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ সুত্র জানায়, এই চক্রে মর্জিনা খাতুন ছাড়াও কয়েকজন মহিলা রয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই যৌন ফাঁদ পেতে শারিরিক সম্পর্ক শুরু করা হয় এবং এর মাঝপথে গিয়ে হাজির হয়ে সেই মহিলাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দেওয়া হয়। পরে সেই ব্যক্তির কাছে মোটা টাকা দাবি করা হয়। দাবি মতো টাকা না দিলে ফাঁদে পা ফেলা পুরুষটির বউকে সেই ছবি দেখানোর ভয়ও দেখায় তারা। প্রয়োজনে তারা ঘটনার সময় পুরুষটির হাতের আংটি, মোবাইল ফোন সেট ও টাকা পয়সা কেড়ে নিতে পিছ পা হয় না। মর্জিনা খাতুন স্বীকার করেছেন, বিজন সরকারের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনেই আলাপ। মানজারুলের নির্দেশ ও পরিকল্পনা মতো সে নিজেই ওই ব্যবসায়ীকে ব্যাঙ্কের ছাদে ডেকে নিয়েছিল। এই ধরনের কারবারের সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত রয়েছে। একই কায়দায় এর আগেও অনেকবার ব্যাংকের ওই ছাদে অনেককে ডেকে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে বলে মর্জিনা স্বীকার করেছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার শিশুরাম ঝাঝারিয়া জানিয়েছেন, মানজারুল সরকার ও মর্জিনা খাতুনের বাড়ি যথাক্রমে কুমারগঞ্জ থানার রাজধারা ও দোমুঠা এলাকার কাশেমমোর গ্রামে। মানজারুলের বাড়িতে স্ত্রীও রয়েছে। দু’জনেরই বিরুদ্ধেই ৩০২ ধারায় মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি এই চক্রের সঙ্গে আর কে কে জড়িত রয়েছে তা জানতে দ্রুতই দুজন’কে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ রকম একটা চক্রের মূল হোতা ও মক্ষীরানিকে গ্রেফতার করতে পারায় রাজ্য পুলিশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বালুরঘাটের মানুষ। পাশাপাশি এই ঘটনা পুলিশের বড় ধরনের সাফল্য বলে অভিনন্দন জানিয়েছেন শহরের বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব জিষ্ণু নিয়োগী। তিনি বলেছেন, পুলিশের উচিত এই চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। তিনি আরও বলেছেন, এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য সাধারণ মানুষকেই বেশি সচেতন হতে হবে। তবে এই ধরনের ঘটনায় সমাজের এক অংশের নারীর পাশাপাশি অভিযুক্ত পুরুষরাও সমান দায়ী বলে মনে করছেন অনেকেই। তাদের মতে সুযোগের সদব্যবহার করতে গিয়েই পুরুষরা এই চক্রের হাতে হেনস্তা হয়েছেন। তাই আকাঙ্খায় লাগাম টানা খুব জরুরী।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়