Friday, November 21

হলুদ সবুজ হেমন্তের নেয়ামত


সাইফ সিরাজ সময়ের মালিক সময়কে আবর্তিত করেন; প্রকৃতির গায়ে এঁকে দেন দৃষ্টিনন্দন আল্পনা। সে আল্পনা একেক সময় একেক রূপে উদ্ভাসিত হয়। উদ্ভাসিত সেই অনন্য রূপকে আমরা দেখি নানা ঋতু হিসেবে। ১২ মাসের ছয় ঋতু নিয়ে আমাদের এ বাংলাদেশ। কালের আবর্তনে, প্রকৃতির বিবর্তনে সবুজের চাদরে নেমে আসে ষড়ঋতুর অনুপম রূপবৈচিত্র্য। ছয়টি প্রকৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ছয়টি অনিন্দ্য শিল্পকর্ম। সুন্দরপিয়াসী মনে নিয়ে আসে চঞ্চলতা। বোধের দিগন্তে হেসে ওঠে অনন্ত রূপের আধার ও রূপ-রস-ছন্দ-আনন্দের মালিকের অলোক সক্ষমতা। ঘোরলাগা অনুভবে ভাবুকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, 'তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর/না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর...' এ সময়ের পালাবদলে প্রকৃতিতে আসে হেমন্তকাল। হেমন্ত হলুদের কাল, সবুজের কাল, মৌ মৌ আমন ধানের আগমনীর কাল। হলুদ চাদরে ঢাকা প্রকৃতির কাল। প্রভাতে সূর্যের কিরণে ধান গাছের সুচালো অগ্রে শিশির নামা হিরক দানার আনন্দ কাল। মায়াবি প্রকৃতির মনোলোভা রূপে পৃথিবীর সজীবতার কাল। ছয় ঋতুর অন্যতম সুন্দর ও আরামদায়ক একটি হলো হেমন্ত। কবির ভাষায় ঋতুরানী। শুভ্র শরতের পরেই প্রকৃতিকে দৃষ্টিসুখ আনন্দে হাসাতে মাটির প্রতিবেশে জেগে ওঠে সরষে হলুদ হেমন্ত। কার্তিক আর অগ্রহায়ণের এ সময় দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবি রোদ। রাতের আকাশে শুভ্রসজাগ থাকে রুপালি তারকারাজি। শুক্লপক্ষের চাঁদের নীলাভ জোছনা দেয় মন ভালো করা অনুভূতি। পূর্ণিমা হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রুপার থালা। মৃদু ছন্দ তুলে শিশির নেমে আসে ঘাসের ডগায়। সবুজ ধানের ক্ষেতে শুরু হয় শিশির আর দুধ-সাদা জোছনার মাখামাখি ভালোবাসা। প্রভুর প্রেমিক পুরো প্রতিবেশে শুনতে পায় রব্বে আলার গুণগান। শিশিরের ছন্দ-শব্দে মূর্ত হয় সুরেলা জিকির। আল্লাহর গোলাম ছুটে যায় জায়নামাজে। অবনত কপাল নেমে আসে তাঁর উদ্দেশে শুকরিয়া সেজদায়। প্রশংসার অনিন্দ সঙ্গীত সুর তোলে যায় ইন্দ্রীয় থেকে ইন্দ্রিয়ান্দরে। প্রভাতি সমিরণে শীতের আগমন ধ্বনি। ঘাসের ডগায় শিশিরকণা মুক্তাদানা হয়ে হেসে ওঠে। সবুজ ধানের ক্ষেত কুয়াশাস্পর্শে হয়ে ওঠে আরও সজীব সুন্দর। রকমারি ধানের নানা ঘ্রাণে মনের ভেতর শুরু হয় মোহঘোর আন্দোলন। পোলাও ধানের ক্ষেতের আলে দাঁড়ালেই পেটের ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কৃতজ্ঞ বান্দার মুখে ও মনে অজান্তেই উচ্চারিত হয় 'আলহামদুলিল্লাহ'। মাঠের পর মাঠ সরিষার হলুদ ফুল দেখে মনে হয় প্রকৃতি তার হলুদ অাঁচলের আদরে ঢেকে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশ। সবুজ ধান আর সরষে হলুদ দিয়ে শুরু হওয়া হেমন্ত একসময় হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যের সোনালি রঙ সোপান। ধনি-গরিব সবার মুখে লেগে থাকে অকৃত্রিম হাসি। বাংলাদেশজুড়ে নেমে আসে এক ঐশী সুখের সুবাতাস। হেমন্তের শেষের দিনগুলোয় সবুজ মাঠ ক্রমে সোনালি রঙে আর হলুদ সরষে ধূসর রঙে বদল হতে থাকে। কাঁচা সবুজ ধান ও হলুদ সরিষার ফুলে ভর করে রিজিক। ধানের পেটে চালের বেড়ে ওঠা আর সরিষার পেটে তেলের বেড়ে ওঠায় কৃষকের আকর্ণ হাসির আড়ালে জেগে ওঠে মহামহিমের কৃতজ্ঞতা। কাস্তে হাতে কৃষকের ধান কাটার অপরূপ দৃশ্যে ছবি হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত হয়ে ওঠে চারপাশ। বাদামি খড়ের বিচালিতে পথ-ঘাট-মাঠ হয়ে ওঠে কুদরতের বিছানা। আমনের ফলনে রিজিকের ফয়সালা হয় মানুষ, পশু আর পাখির। ভোরের নাশতায় হেসে ওঠে শুভ্র খই। সেই সঙ্গে খেজুর গুড় ও রসের শুরু হয় আগমনী গান। হেমন্তের আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ। শেষের দিকে শুরু হয় শীতের আগমন। রাত হতে থাকে দীর্ঘ। প্রেমিক বান্দার ঘুম ভেঙে যায় রাতের শেষে। গ্রীষ্মকালে রাত ছোট থাকায় অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন না। হেমন্ত আসতেই রাত দীর্ঘ হতে শুরু করায় তাহাজ্জুদের সুবর্ণ সুযোগ এটি। সমগ্র ভালোবাসার নৈবেদ্য নিয়ে হাজির হয় প্রভুর দরবারে। চোখের জলে নেমে যায় পাপের অতীত। মহান আল্লাহ বান্দাকে এমন নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতি দেয়ার একটা উদ্দেশ্য, বান্দা শান্তি ও আরামের সঙ্গে মশগুল হবে ইবাদতে। যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন, কোরআন তাদের মুহসেন ও মুত্তাকি নামে অভিহিত করে। তাদের আল্লাহর রহমত এবং আখেরাতে চিরন্তন সুখ সম্পদের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই মুত্তাকি লোক বাগ-বাগিচায় এবং ঝরনার আনন্দ উপভোগ করতে থাকবে এবং যে নিয়ামত তাদের পরোয়ারদিগার তাদের দিতে থাকবেন, সেগুলো তারা গ্রহণ করবে। (কারণ) নিঃসন্দেহে তারা এর আগে (দুনিয়ার জীবনে) বড় পুণ্যবান ছিল। তারা রাতের খুব অল্প অংশেই ঘুমাত এবং শেষ রাতে এস্তেগফার করত। (কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মাগফিরাত চাইত)'। (সূরা জারিয়াত : ১৫-১৮)। রাসূল (সা.) বলেছেন, রাতের শেষ সময়ে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার দিকে নাজিল হন এবং বলেন, 'ডাকার জন্য কেউ আছে কি, যার ডাক আমি শুনব; চাওয়ার জন্য কেউ আছে কি, যাকে আমি দেব; গোনাহ মাফ চাওয়ার কেউ আছে কি, যার গোনাহ আমি মাফ করব?' (বোখারি)। হেমন্তের আগমনধ্বনি যখনই নেমে আসে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে, তখনই অতিথি পাখিরাও আসতে থাকে। হাজার মাইল দূরের সেই পাখিদের আগমনীতে প্রতিভাত হয় আল্লাহর অনন্যতা। তিনি প্রকৃতিতে নিয়ে আসেন নানা অবস্থা। আবার সে অবস্থায় নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে দেন তিনিই। তাই পাখিরাও তীব্র শীত থেকে বাঁচতে কম শীতের বাংলাদেশে চলে আসে। মুখর হয়ে ওঠে বাংলার বিল-ঝিল-সরোবর। ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ, প্রাণী, পশুপাখির জীবনযাত্রায় আসে পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের একমাত্র ক্ষমতা মহান আল্লাহর হাতে। তিনি এসব পরিবর্তনের মধ্যেই বান্দার জন্য রাখেন প্রভূত কল্যাণ আর ইতিবাচক শিক্ষা। বান্দার অভিব্যক্তি হিসেবে ভাষা পায় তা কোরআনে করিমে, 'আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান।' (সূরা আলে ইমরান : ২৭)। কালের এমন বিবর্তনের ব্যাপারে আল্লাহ আরও বলেন, 'নিশ্চয় আসমানগুলো ও জমিনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নিদর্শন।' (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)। হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। প্রতি রাতেই কোথাও না কোথাও বসে ইসলামী আলোচনার আসর। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পরপরই শুরু হয় হালকা গরম কাপড় কাঁধে বয়স্কদের মাহফিলের দিকে হেঁটে চলা। চলতে থাকে কিশোর-যুবারাও। বৃষ্টি ও ঝড়ের সম্ভাবনা না থাকায় এ সময়ই আমাদের দেশে বসে নানা আনন্দ-উৎসবও। হেমেন্তের সমাপনী দিনগুলোতে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নেমে আসে নবান্ন উৎসবের আনন্দ। রকমারি পিঠার আয়োজনে মেতে ওঠে পুরো দেশ। আল্লাহর গোলাম এসব আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যায়। সেজদায় অশ্রুপাতে দেয় শুকরিয়ার নজরানা। ষড়ঋতুর অন্যতম এ হেমন্ত আরাম-শান্তি-সুখ আর ইবাদতের ঋতু হয়ে ওঠুক আমাদের সবার মনে-অন্দরে। লেখক : প্রভাষক, রাজঘাট দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসা, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়