Wednesday, October 22

ভয়ঙ্কর সুন্দরের মুখোমুুখি দাঁড়িয়ে


এম এ খালেক : প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল আমরা চট্টগ্রামের শীতাকুন্ডু ভ্রমণে যাবো। সময় এবং সুযোগ হলে সেখান থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে ঢাকা ফিরে আসবো। সেভাবেই প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু প্রফেসর সাহেব (অধ্যাপক জহিরুল হক ভুইয়া) বললেন যেহেতু খাগড়াছড়ি দূরবর্তী গন্তব্য তাই সেখানে আগে গেলে ভালো হয়। আসার পথে আমরা শীতাকুন্ডুতে এক দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করবো। প্রফেসর সাহেবের প্রস্তাবে এনায়েত ভাই (সাহিত্যিক কাজী এনায়েত হোসেন) সম্মতি প্রদান করায় আমার আর আপত্তি করার কিছু থাকলো না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো আমরা ৮ অক্টোবর, ২০১৪ তারিখ সকালে ঢাকা থেকে যাত্রা করবো। আমার ইচ্ছে ছিল রাতের বেলা যাত্রা করবো। কারণ আগের প্রতিটি ভ্রমণের ক্ষেত্রেই রাতের বেলা যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু প্রফেসর সাহেব তার অভিজ্ঞতার আলোকে বললেন, দিনের বেলা যাত্রা শুরু করলে যাত্রা পথের আশে-পাশের সব দৃশ্য ভালোভাবে দেখা সম্ভব হয়। ভ্রমণের ক্ষেত্রে আশে-পাশের দৃশ্য অবলোকন করাটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি বেসরকারি কোম্পানির বাসের টিকেট আগেই ক্রয় করা হয়েছিল। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির জন্য জনপ্রতি টিকিটের দাম নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আমি আর প্রফেসর সাহেব মালিবাগ থেকে একই সঙ্গে কমলাপুর যাবো। আর এনায়েত ভাই মীরপুর থেকে সরাসরি কমলাপুর বাস স্ট্যান্ডে চলে আসবেন। আমার ভয় ছিল আমরা নির্ধারিত সময়ে বাস স্ট্যান্ডে উপস্থিত হতে পারলেও এনায়েত ভাই সম্ভবত বিলম্ব করে ফেলবেন। তার মতো আত্মভোলা মানুষের পক্ষে বিলম্ব করাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এনায়েত ভাই আমাদের অনেক আগেই বাস স্ট্যান্ডে উপস্থিত হন। সকাল সোয়া ৮ টায় বাস স্টেশন ছাড়ার কথা থাকলেও দু’মিনিট আগেই রওনা দেয়। তাদের এই সময় জ্ঞান খুবই ভালো লাগলো। ভাবলাম বাসের ম্যানেজমেন্ট খুবই ভালো। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ভুল ভাঙ্গলো। পরবর্তী স্টপেজ থেকে বেশ কয়েক জন যাত্রী বাসে উঠলেন। কিন্তু দেখা গেল তাদের সবার নিকট থেকেই বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া একই সীট দু’জনের নিকট বিক্রি করা হয়েছে। এ নিয়ে যাত্রীরা বাস সুপারভাইজারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। যা হোক কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনো ঘটেনি। রাস্তায় কোনো ধরনের যানজট ছিল না। ফলে বাস স্বাচ্ছন্দের সঙ্গেই দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। বাসের ঝাঁকুনিতে একটা তন্দ্রভাব এসেছিল। তাই বুঝতে পারিনি কখন আমরা কুমিল্লা শহরের নিকটে চলে এসেছি। সেখানে একটি রেস্টুরেন্টের নিকট ২০ মিনিটের জন্য যাত্রা বিরতি দেয়া হলো। আমরা এখানে নেমে হাল্কা নাস্তা এবং চা খেলাম। সেখান থেকে আবারো যাত্রা শুরু করে আমরা বেশ স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফেনী পার হয়ে চট্টগ্রামের মীরসরাই পৌঁছে যাই। সেখান থেকে বাম দিকে মোড় নিয়ে বাস পূর্ব দিকে করেরহাটের দিকে চলতে থাকে। আমরা যতই পূর্ব দিকে যাচ্ছিলাম ততই ছোট-বড় উঁচু-নিচু পাহাড় দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। দু’দিকে পাহাড় তার মাঝে বিপদ সঙ্কুল রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলছিল। কোথাও গাড়ি বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিল। আবার কখনো বা পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা উপরে উঠে যাচ্ছিল। পাহাড়ি রাস্তার এই চড়াই-উতরাই পেরুনোর সময় প্রচন্ড ভয় করছিল। কোনো কারণে একবার যদি গাড়ি ব্রেক ফেল করে নিচে পড়ে যায় তাহলে আর রক্ষা নেই। এভাবে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে বিকেল প্রায় ৪ টার সময় আমরা খাগড়াছড়ির আলুটিলায় উপস্থিত হলাম। পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম,খাগড়াছড়ি শহরে যাবার পথে আলুটিলা যাত্রা বিরতি করবো। সেখানে খাবার গ্রহণ করার পাশাপাশি আলুটিলা রহস্যময় সুরঙ্গ(পাহাড়ি গুহা) দেখবো। আমরা আলুটিলায় নেমে কিছুটা বোকা বনে গেলাম। কারণ এখানে কোনো খাবার দোকান খোলা নেই। একটি মাত্র রেস্টুরেন্ট থাকলেও তা বন্ধ রয়েছে। অগত্যা আমরা দুপুরের খাবার না খেয়েই আলুটিলা পাহাড়ি সুরঙ্গ দেখতে চললাম। এ জন্য জনপ্রতি ৫ টাকা করে টিকেটে কাটতে হলো। আলুটিলা পাহাড়ি সুরঙ্গ দেখতে গিয়ে সবচেয়ে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা অর্জন করি। সুরঙ্গের ভিতরে প্রবেশ করা যে কত বড় বোকামি ছিল তা মর্মে মর্মে টের পেলাম একটা পরই। আলুটিলা পাহাড়টি বেশ উঁচু। পাহাড়ের নিচে সুরঙ্গের অবস্থান। সেখানে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। ফলে যারা সুরঙ্গে প্রবেশ করতে চান তারা উপর থেকে মশাল কিনে নিয়ে যান। সেই মশালের আলোয় সমস্যা সঙ্কুল গুহায় রাস্তা চলতে হয়। আমরা দু’টি মশাল কিনে সুরঙ্গের প্রবেশ পথে উপস্থিত হই। কিন্তু তখনও অনুধাবন করতে পারিনি যে ভিতরে আমাদের জন্য কি বিপদ অপেক্ষা করছে। কি নির্মম অভিজ্ঞতাই না আমরা অর্জন করতে চলেছি। আমি এবং এনায়েত ভাই সুরঙ্গে প্রবেশ করি। এমন সময় প্রফেসর সাহেবের ছেলে নাজমুল ভুটান থেকে ফোন করে। নাজমুল তার বাবাকে বলে,তোমার পায়ের ব্যথা তাই সুরঙ্গে নামতে যেও না,সমস্যা হতে পারে। ছেলের কথা শুনে তিনি সুরঙ্গে প্রবেশ করা থেকে বিরত হন। আমার কেনো যেনো মনে হলো,সুরঙ্গে নামতে এসে ফিরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে এক ধরনের ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে ভাবেই হোক সুরঙ্গ পেরুতে হবে। একটু পরই বিপদ টের পেলাম। সুরঙ্গের সরু পথ অত্যন্ত পিচ্ছিল এবং বিপদ সঙ্কুলভাবে উপরের দিকে উঠে গেছে। ফলে সেখানে কোনোক্রমেই স্বাভাবিকভাবে চলাচল করা সম্ভব নয়। সুরঙ্গের মাঝ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথর। পাথরগুলো শেওলাযুক্ত। মাঝামাঝি যাবার পর এনায়ের ভাই প্রস্তাব করলেন ফিরে আসার। কিন্তু আমি কোনোভাবেই ফিরে আসতে রাজি হলাম না। কারাণ আমার মনে হচ্ছিল যে,এখান থেকে ফিরে যাওয়া মানে পরাজয়কে নেমে নেয়া। ধীরে ধীরে চলতে থাকলাম। এক পর্যায়ে আমার মশালের আলো নিভে গেল। চারিদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। কোনো যেনো মনে হলো,আজ আর আমার ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। মৃত্যুভয় আমাকে গ্রাস করে ফেলে। মনে হচ্ছিল,এখনই বোধহয় সুরঙ্গের মাটি ধ্বসে পড়বে। তাহলে আর ফিরে যাবার কোনো রাস্তাই খোলা থাকবে না। মানুষ বিপদে পতিত হলে নানা ধরনের আশঙ্কা এবং ভীতিকর কল্পনা মনে আসতে থাকে। আমারও তাই হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার স্ত্রী এবং মেয়েদের সঙ্গে বুঝি আর দেখা হবে না। তারা জানতেও পারবে না আমি কিভাবে হারিয়ে গেলাম। আমি দোয়া-দরুদ পড়তে থাকলাম। আমার এক হাতে ছিল জুতা অন্য হাতে ব্যাগ। ব্যাগের ওজন হবে প্রায় ১০/১২ কেজির মতো। এ অবস্থায় আমি মারাত্মক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। ব্যাগ ছেড়ে দেবো তাও পারছিলাম না। কারণ ব্যাগের ভেতরে ক্যামেরাসহ কিছু মূল্যবান জিনিষ ছিল। কোনোভাবেই তাল রাখতে পারছিলাম না। এমনি অবস্থা আমি পা পিছলে পড়ে যাই। এতে আমার ডান পায়ের গোড়ালির উপরে বেশ কিছু অংশের চামড়া উঠে যায়। প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। আরো যারা দর্শনার্থী ছিলেন তাদের সবার হাতেই মশাল ছিল। ফলে সুরঙ্গের ভিতরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। আমি পড়ে যাবার কারণে সুরঙ্গের চলাচলের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যায়। এ সময় গুহার ভিতরে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছোট ছোট কয়েকটি বাচ্চা কান্না শুরু করে দেয়। তখন পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারন করে কেউ একজন আমার হাত ধরে টেনে তুলে একটি পাথরের উপর দাঁড় করিয়ে দেন। আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে পুনরায় চলতে শুরু করি। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যত দুর্গম পথই হোক আমাকে তা পাড়ি দিতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমার পা আর চলতে চাইছিল না। এমন বিপদের সময় ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তখন মনে পড়ে গেল দুপুরে তো আমাদের খাওয়া হয় নি। মনে শক্তি সঞ্চয় করে আবারো চলতে শুরু করি। কিছু দূর যাবার পর সুরঙ্গের প্রান্তে আলোর রেখা দেখতে পাই। আমার মনে ক্ষীণ আশা সঞ্চার হয়। আল্লাহ্ বোধ হয় আমার বেঁচে থাকার আকুল প্রার্থনা কবুল করেছেন। সুরঙ্গের শেষ ধাপ আর উঠতে পারছিলাম না। একটি ছেলে আমার ডান হাত ধরে টেনে উপরে তুলে আনে। আমি যেনো নতুন করে জীবন ফিরে পেলাম। উপরে উঠে কিছুক্ষণ রেলিং এর উপর বসে থাকি। তারপর অনেক কষ্টে উপরে চলে আসি। সেখানে হাল্কা নাস্তা করি। আলুটিলা পাহাড়ি সুরঙ্গ অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি দর্শনীয় স্থান। অথচ কি বিপদ সঙ্কুল অবস্থায়ই না এটি পড়ে আছে। এমন কি সুরঙ্গের মুখে কোনো সতর্ক বাণীও লেখা নেই। যে কোনো মানুষ এখানে এসে জীবন হারাতে পারেন। কর্তপক্ষ কেনো বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছেন না সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। এই সুরঙ্গে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা একান্ত জরুরি। এ ছাড়া এক বা একাধিক গাইড নিয়োগ দেয়া যেতে পারে,যারা দর্শনার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করবেন। কি কারণে বিপদ ঘটতে পারে তা বুঝিয়ে দিতে পারেন। বর্তমান অবস্থা কোনো বিপদ ঘটলে তার দায় কে বহন করবেন? আর একটি ব্যাপার আমাদের সবারই স্মরণ রাখা দরকার তাহলো,ভালোভাবে না জেনে কোনো কাজেই ঝুঁকি নেয়া উচিৎ নয়। এ ধরনের ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষেত্রে যে কোনো সময় মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমরা রাত্রী যাপনের উদ্দেশে সম্ভাব্য গন্তব্যে স্থল পর্যটন মোটেলের দিকে যাত্রা শুরু করি। আলুটিলা থেকে পর্যটন মোটেল পর্যন্ত যেতে একটি স্কুটার ২৫০ টাকা ভাড়া চাইলেন। ভাড়া বেশি মনে হলেও আমরা কোনো আপত্তি উত্থাপন না করে রওনা দিলাম। কারণ আমাদের তখন বিশ্রমের খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পর্যটন মোটেলে গিয়ে আমাদের আশাহত হতে হলো। কারণ এখানে কোনো ভালো রুম খালি পাওয়া গেল না। তাই আবারো আমরা শহরের দিকে রওনা দিলাম। সেখানে প্রথমেই আমরা দুপুরের খাবার গ্রহণ করি,যদিও দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। খাবার গ্রহণ করার পর আমরা প্রথমে যাই নিলয় নামে একটি হোটেলে কিন্তু এখানেও সিট খালি পাওয়া গেল না। পরে আমরা শৈল সুবর্ণা নামে একটি হোটেলে উঠি। মাঝারি মানের এই হোটেলটি আমরা পছন্দ করি কারণ এটি শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত। রাতের খাবার খেতে গিয়ে আমরা পরদিনের গন্তব্য সাজেক ভ্যালি যাবার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিই। জানতে পারি সাজেক ভ্যালি যেতে হলে একমাত্র বাহন হচ্ছে ‘চাঁন্দের গাড়ি।’ চাঁন্দের গড়ি হচ্ছে অনেকটা জিপের মতো একটি বাহন। এই বিচিত্র নামের কারণ জানতে চাইলে একজন চালক জানালেন,এই গাড়ি যে কোনো রাস্তায় চলাচল উপযোগি। এমন কি পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পথে চলতেও এটা প্রায় বিকল্প হীন। তাই একে স্থানীয়ভাবে চাঁন্দের গাড়ি বলা হয়। এখান থেকে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে সাজেক ভ্যালি যেতে হবে। সাজেক ভ্যালিতে রাত্রি যাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমন কি খাবার জন্য কোনো রেস্টুরেন্টও পাওয়া যায় না। সাজেক ভ্যালির অবস্থান রাঙ্গামাটি জেলায়। তবে নতুন বিকল্প রাস্তা দিয়ে খাগড়াছড়ি থেকেও সেখানে যাওয়া যায়। চাঁন্দের গাড়ির একজন চালকের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানালেন,৫ হাজার টাকা দিলে তিনি যেতে পারেন। আমরা তার সঙ্গে কোনো কিছু চূড়ান্ত না করেই বিদায় নিলাম। হোটেলে যাবার সময় নিলয় হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বললেন,আমাদের হোটেলে কয়েকজন ছাত্র বোর্ডার আছেন যারা ঢাকা থেকে এসেছেন। আমি বলে তাদের সঙ্গে আপনাদের সাজেক ভ্যালি যাবার ব্যবস্থা করতে পারি। আমরা মোবাইল নম্বর দিয়ে ফিরে আসি। রাতের বেলা আনিস নামে এক ছাত্র ফোনে আমাদের জানালেন,আমরা তাদের সঙ্গে যেতে পারবো। তিনি আরো জানালেন,সকাল পৌনে ৮ টার মধ্যে শাপলা চত্ত্বরে আসতে হবে। আমরা হোটেলে ফিরে আসি। কিন্তু রাতের বেলা ভালো ঘুম হলো না। বলতে গেলে বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করলাম। সকালে নির্ধারিত সময়ে শাপলা চত্ত্বরে উপস্থিত হলাম। এর আগেই সকালের নাস্তা খেয়ে নিলাম। সকাল সোয়া ৮টার মধ্যেই চাঁন্দের গাড়ি চলা শুরু করে। সে এক নতুন অভিজ্ঞতাই বটে। যাবার পথে রাস্তার দু’ধারে বিশাল আকৃতির পাহাড় আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। কোনো কোনো পাহাড়ের ঢাল এতই ভয়ঙ্কর যে একবার গাড়ি ব্রেক ফেল করলে কোনোভাবেই বাঁচার উপায় নেই। গাড়ি চলছিল খুবই আস্তে আস্তে। এক সময় আমরা বহুল আকাঙ্খিত সাজেক ভ্যালিতে উপস্থিত হলাম। রাস্তার মাঝে মাঝেই সেনা বাহিনী এবং বিজিবি’র দায়িত্ব পালনরত সদস্যদের নিকট থেকে অনুমতি গ্রহণ করতে হচ্ছিল। সাজেক ভ্যালিতে যাবার পর সেখানকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠার জন্য সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু শারিরিক সামর্থ্যরে কথা চিন্তা করে আমি আর প্রফেসর সাহেব নিচে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের সঙ্গে এক এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী-পুত্র ছিলেন। তারাও আমাদের সঙ্গে থেকে গেলেন। আমরা আশে-পাশে এলাকায় ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল দুপুরের খাবার কি ভাবে সংস্থান করবো তা নিয়ে। এর একটি সহজ সমাধান আমরা বের করলাম। একজন উপজাতি মেম্বারের সঙ্গে আলাপ করে তার বাসায় দুপুরের খাবার গ্রহণের ব্যবস্থা করলাম। এ জন্য তাকে সামান্য কিছু অর্থ প্রদান করা হলো। দুপুরের আগেই রান্না শেষ হয়ে গেছে। আমরা দুপুরের খাবার গ্রহণ করে আবারো মূল সড়কে চলে আসি। এখানে একজন উপজাতি ধর্ম প্রচারকের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সাজেক ভ্যালির ঐতিহ্য এবং ইতিহাস জানালেন। তিনি আমাদের চা দ্বারা আপ্যায়ন করলেন। এর আগে বিজিবি চেক পোষ্টে কর্মরত দু’জন সদস্যের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তারা তাদের সমস্যা সম্পর্কে আমাদের বলছিলেন। তারা জানালেন,আগে সাজেক ভ্যালিতে আসতে খুব অসুবিধা হতো। এখন নতুন সংযোগ সড়ক নির্মিত হবার ফলে এখানে আসা অনেকটাই সহজ হয়েছে। বিজিবি’র উদ্যোগে একটি রিসোর্ট নির্মিত হয়েছে,যা ১২ অক্টোবর উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এটা সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তখন সাজেক ভ্যালি আরো আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হবে। আমরা অনেক ক্ষণ এই এলাকায় ঘুরাঘুরি করলাম। এর মধ্যে ছাত্ররা ফিরে আসে। আমরা বিকেল চারটায় খাগড়াছড়ি শহরের দিকে রওনা দিলাম। আশে-পাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে শহরে ফিরে এলাম। শহরে রাত যাপন করে পরদিন ঢাকা ফিরে আসি। ঢাকা আসার সময় সরাসরি বাসের টিকিট না পাবার কারণে খাগড়াছড়ি থেকে ফেনি এবং সেখান থেকে অন্য একটি বাসে ঢাকায় চলে আসি। খাগড়াছড়ি ভ্রমণ আমাদের জন্য ছিল বিরল একটি ঘটনা। খাগড়াছড়ি ভ্রমণ দীর্ঘ দিন মনে থাকবে,বিশেষ করে আলুটিলা সুরঙ্গের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কোনোভাবেই ভুলতে পারবো না। (এম এ খালেক, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়