মাসুম সায়ীদ
রাতে থেকে থেকে বৃষ্টি হয়েছে। সে রকম ভারি নয় অবশ্য। মেঘের তর্জন-গর্জন বা বাতাসের মাতামাতিও ছিল না। সেতারের তারে আঙুলের নাচন যেমন। ভোরবেলায় ঘাসে, গাছের পাতায় হীরক কুচি বৃষ্টিকণা আর ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ মনে করিয়ে দিল রাতের বৃষ্টিকে। সিলেট-তামাবিল রোড ধরে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। সিলেট বাইপাস মোড় পেরিয়ে উত্তরমুখো একটা কাঁচা রাস্তায় নামল খানিক বাদে। মিনিট পনেরো যাওয়ার পর শুরু হলো বন। সামনে বসার সুবাদে বনের দুই পাশটা চোখে পড়ছিল। খাদিমনগর দেশের কনিষ্ঠ জাতীয় উদ্যান। ২০০৬ সালে একে গোত্রভুক্ত করা হয়। মোট আয়তন ৬৭৯ হেক্টর। দুই ঘণ্টার ও আধা ঘণ্টার দুটো ট্রেইল আছে। দুই ঘণ্টার ট্রেইল শুরু হয়েছে বিট অফিসের সামনে থেকে। বিট অফিসের বেঞ্চিতে বসে দলনেতা শাহিন ভাই লেবু পানি বিতরণ করলেন। বুঝলাম ট্র্যাকিংয়ের প্রস্তুতি এটা।
অফিস ভবনের পর থেকে শুরু হয়েছে বাঁশবন। মহীরুহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা ধরনের বাঁশ আকাশ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতেছে। টিলায় টিলায় বাঁশবন আর পাহাড়ের গায়ে ও চূড়ায় চূড়ায় নানা ধরনের গাছগাছালি। প্রত্যেকে আপন মহিমায় উজ্জ্বল। এক সময় বাঁশেরই বন ছিল এলাকাটা। ১৯৬০ সালে বাঁশবন পরিষ্কার করে বনায়ন করা হয়। প্রায় পাতা ঝরা ক্রান্তীয় এই বনে অন্য গাছগাছালির পাশাপাশি প্রায় সর্বত্রই নানা রকম বাঁশ চোখে পড়ে। ট্রেইলে ট্র্যাকিংয়ের সুবিধার্থে নম্বরযুক্ত পিলার পোঁতা হয়েছে। তিন নম্বর পিলারের পর বন ক্রমেই ঘন আর নিবিড়। বনে বসবাসকারীদের মধ্যে আছে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৯ প্রজাতির উভচর, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২৫ প্রজাতির পাখি।
পথের মুখে যে ছড়াটি রেখে এসে ছিলাম দুই নম্বর পিলারের পর আবার তার দেখা মিলল। এখানে ঢাল বেশ খাড়া। তাই পানিতে লুটোপুটির শব্দ। নিস্তব্ধ বন পথে মৃদু এই শব্দ কানে বাজে স্পস্ট। ছড়ার ওপর দুটো মাত্র বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছে। বেশ পুরনো। যথেষ্ট সতর্ক থাকার পরও একটি ভেঙেই গেল। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটল না। তৃতীয় পিলারের পর বন আরো গভীর। অজানা এক পাখি মিষ্টি সুরে ডেকে গেল। কয়েকটা প্রজাপতি বারকয়েক ঘুরে গেল গা ঘেঁষে। বন আর পাহাড়ের একটা রহস্য আছে, তা হলো এগিয়ে চলার আকর্ষণ। চারপাশের দৃশ্যই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বারবার। তবু মন ফিরতে চায় না। গ্রিক পুরাণের নির্জন দ্বীপের সাইরেনদের গানের মতোই আত্মমগ্ন সে টান। ভাবের ভোলা আমাদের পেয়ে বসলেও দলনেতা ছিলেন সজাগ। তাই বন থেকে বেরোতেই হলো।
খাদিমনগর থেকে জাফলংয়ের পথে খানিকটা এগিয়ে গেলে ঠাকুরের মাটি গ্রামের পাশেই চিকনাগুল চা-বাগান। এটা খাদিমনগরের আর একটি আকর্ষণ। এবারের গাইড আমাদের লেগুনার চালক রমজান ভাই। তার বাড়ি চা বাগানের কাছেই টিলার ওপর গড়ে ওঠা একটা পাড়ায়। চা বাগান থেকে ফেরার পথে পাড়াটা আমরা দেখেছি। টিলাটার পা ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির ছড়া। আর ঢালে ঢালে এক একটি বাড়ি।
ঠাকুরের মাটি গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি ঝিরি। ঝিরির ওপাশ থেকে চা বাগান শুরু। সার সার টিলা আর টিলার মাঝে উপত্যকাতে চা গাছ। টিলার কোল ঘেঁষে শাড়ির পাড়ের মতো আঁকাবাঁকা পথ। পায়ে চলার সরু রেখা ছেড়ে আমরা উঠে আসি সেই পথে। সব চা বাগানের মতো এখানেও বড় বড় শেড ট্রি আছে, তবে ব্যতিক্রম হলো বাঁশবন। হাতের লাঠির মতো চিকন বিশেষ এক ধরনের বাঁশ এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। পাতাগুলো যেমন বড় তেমন প্রশস্ত আর ঘন। বাঁশবনে বনমোরগ পাওয়া যায়। রাতের বেলায় টর্চলাইট হাতে শিকারিরা বাঁশবনে পিছু নেয় বনমোরগের।
এই চা বাগানের যে রূপ তা ভাষায় প্রকাশ দূরে থাক, কোনো চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলাও অসম্ভব। সদ্য বর্ষাস্নাত সবুজের এমন দীপ্তি! এক সবুজের মধ্যে এত ভিন্নতা আবার সতেজ ঐক্যের এমন তান! বিস্ময়ে আর মুগ্ধতায় বাক্যহীন হয়ে যাই। ক্যামেরা হাতে শিকড় গজায় আমাদের পায়। সময় এখানে কেবলই থমকে যেতে থাকে বারবার। ছবি : লেখক
খবর বিভাগঃ
দর্শনীয় স্থান
বিশেষ খবর
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়