Tuesday, June 4

বন, জীবন ও পরিবেশ

জিবলু রহমান:
‘ওভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত এই গানটির বক্তব্যের সাথে সারা পৃথিবীর মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরাও একমত। সত্যিই এক অনন্য উর্বর ভূখন্ড আমাদের এই বাংলাদেশ। পাহাড়, টিলা, গরান, সমতল, বালিয়ারী, সমভূমি, উপকূল সবই আছে আমাদের। জালের মত ছড়ানো ১০৭টি নদী, উপ-নদী প্রাণ সঞ্চার করে চলেছে এই মৃত্তিকার। পূর্বদিকে পাহাড়-টিলা, উত্তরে পাহাড় সমতল, পশ্চিমে নদী বিধৌত আঁড়ি, দক্ষিণে লোনা পানির সাগর, বেলে, বেলে দুআঁশ, আঠাল কাদা, পলি সকল প্রকার মাটির সমন্বিত এক উর্বর ভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। শুধুমাত্র মরুভূমি ও উঁচু পর্বতমালা ছাড়া সকল ধরনের ঊপড়ষড়মরপধষ ঈড়হফরঃরড়হ এখানে বিদ্যমান। মূলত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, ও মেঘনা-তিনটি বড় নদীর অববাহিকা হিসেবেই বাংলাদেশের ভূভাগ গর্বিত। এই নদীগুলোর শাখা নদী-উপনদী শাখা-প্রশাখা জালের ন্যায় বিস্তৃত পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমের পাহাড়ী এলাকা মূলত হিমালয়ে বিস্তৃত যা ঘন ঘন পাহাড়ী বনে আচ্ছাদিত। দক্ষিণ-পশ্চিমে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। মাঝখানে মধুপুর বন ৩৭২ বর্গমাইলের একটি খন্ডিত ভিণ্ণ বন। ১৯৭২ সালের এক হিসাবে বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ ৮৪৮২.২২ বর্গ মাইল ছিল। যা মোট বন ভূমির ১৫.৫৭ ভাগ বর্তমানে এই পরিমাণ ৭ ভাগেরও নীচে চলে এসেছে। যেখানে একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বন থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মাটির গঠন যেমন বৈচিত্রময় তেমনই বৈচিত্রময় এদেশের জলবায়ু। জলবায়ু আবর্তিত হয় ঋতু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। বাংলাদেশের অবস্থান উপ-উষ্ণ মন্ডলীয় অঞ্চলে। যা বৈচিত্রময় বৃক্ষরাজি বন-বনানী, ফুল-ফলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য একটি প্লাবন ও নিচু ভূমির দেশ। বৈশ্বিক বনজসম্পদ ও দেশীয় বনজসম্পদ উজাড়ের কারণে জলবায়ুর যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার অন্যতম প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এটি। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশ যত বড় এলাকার পানি নিঃসরণ করে তার ৯৪ শতাংশ এলাকার অবস্থান দেশের বাইরে। হিমালয়ের বরফ গলার কারণে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে বন্যার প্রবণতা আরো বাড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরো বেড়ে গিয়ে উপকূলগুলোকে করবে আরো সঙ্কটপূর্ণ। এর ফলে অনেক এলাকা চলে যাবে পানির নিচে। বেশীর ভাগ এলাকা ধ্বংস হয়ে যাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। ১৯৯০ সালে যেখানে বৃক্ষাচ্ছাদিত বনের পরিমাণ ছিল ৯.২ শতাংশ সেখানে ২০১৩ সালে বিশেষজ্ঞদের মতে বনাঞ্চলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা, জনগণের অংশগ্রহণ এবং বন বিভাগের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে। বনাঞ্চল ধ্বংস থেকে রক্ষার জন্য সরকার বেশকিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে এক লাখ একানববই হাজার তিরাশি হেক্টর বনভূমি নিয়ে সাতটি অভয়ারণ্য সৃষ্টি। এগুলো হলোঃ ১. সুন্দর বন পূর্ব বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ২. সুন্দরবন পশ্চিম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ৩. সুন্দরবন দক্ষিণ বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ৪. রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ৫. চর কুকড়ি-মুকড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ৬. পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ৭. চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বন সংরক্ষণ ও ইকোটুরিজম উন্নয়নের স্বার্থে আরো প্রায় পঞ্চাশ হাজার হেক্টর বনভূমিকে সংরক্ষিত করে আটটি ন্যাশনাল পার্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। ন্যাশনাল পার্কগুলো হলোঃ ১. টাঙ্গাইলের মধুপুর ন্যাশনাল পার্ক, ২. গাজীপুরের ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক, ৩. কক্সবাজারের (দক্ষিণ) হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্ক, ৪. মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক, ৫. দিনাজপুরের রামসাগর ন্যাশনাল পার্ক, ৬. রাঙ্গামাটির কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্ক, ৭. নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ ন্যাশনাল পার্ক ও ৮. কক্সবাজারের (উত্তর) মেধা কচ্ছাপিয়া ন্যাশনাল পার্ক। ১৯৭৩ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশের আওতায় এসব অভয়ারণ্য এবং ন্যাশনাল পার্ক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকা থেকে বনজসম্পদ আহরণ বা বন্যপ্রাণী নিধন বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ৩টি বোটানিক্যাল গার্ডেন, ৫টি ইকোপার্ক, ১টি সাফারি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলো হলোঃ ঢাকার মিরপুরের ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন এবং সীমাকুন্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন। ইকোপার্কগুলো হলোঃ ১. সিলেটের মাধবকুন্ড, ২. শেরপুরের গজনী, ৩. সিলেটের মুরাইছড়া, ৪. শেরপুরের মধুটিলা এবং ৫. চট্টগ্রামের বাঁশখালী। বনের সঙ্গে জীববৈচিত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক সোহরাবউদ্দিন সরকারের সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৯৩২ প্রজাপতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৩ ধরনের এ্যামফিবিয়ান, ১৪৪ ধরনের র্যাংপটাইল, ৬৩২ ধরনের পাখি এবং ১২৩ ধরনের ম্যামালস রয়েছে। আইইউসিএনের লাল বইয়ের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে আট ধরনের এ্যামফিবিয়ান, ৪০ প্রকারের ম্যামালস, ৪৯ প্রজাপতির র্যালপটাইল এবং ৪১ প্রজাপতির পাখি সঙ্কাটাপন্ন ও বিলীন হওয়ার তালিকায় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে এ ধরনের তালিকায় রয়েছে পাইথন, রাজকোবরা, মেছোবাঘ, হাতি, বন কুকুর, খরগোশ, বন্যশুকর, বিভিন্ন প্রজাতির শিয়াল, বনবিড়াল, লাল সাপ, লজ্জাবতী বানর ইত্যাদি। এছাড়া কাঠ ঠোকরা, ময়না, বুলবুলি, সাত ভাই এমনকি পেঁচার মতো পাখিও সঙ্কাটাপন্ন ও বিলীন হওয়ার তালিকায় রয়েছে। চিতা, নীল গাই, প্যারাহরিণ, গন্ডার, বনগরু, মিষ্টি পানির কুমির, রাজ ধনেশ, রাজ শকুন-এগুলো এই তালিকায় রয়েছে। এটা হয়েছে বনাঞ্চল কমে যাওয়ার কারণে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের প্রায় ৪০ ভাগ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও এফএও’র যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে বৃক্ষাচ্ছাদিত বনের পরিমাণ ছিল মোট ভূমির ৯.২ শতাংশ। সাম্প্রতিক বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, কোস্টাল ফরেষ্ট, সমতল বনভূমি ও গ্রামীণ বন মিলিয়ে দেশের বনভূমি দেশের মোট ভূমির ১৭.৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২.৫৬ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি বন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে সুন্দরবন এবং উপকূলীয় বনের পরিমাণ ০.৬৯ মিলিয়ন হেক্টর, পাহাড়ি বনের পরিমাণ ০.৬৭ মিলিয়ন হেক্টর, শ্রেণী বিন্যাসহীন বনাঞ্চলের পরিমাণ .৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, সমতল ভূমির বনের (যেমন শালবন) পরিমাণ ০.১২ মিলিয়ন হেক্টর, চা ও রাবার বাগানের পরিমাণ ০.০৭ মিলিয়ন হেক্টর, গ্রামীণ বনের পরিমাণ ০.২৮ মিলিয়ন হেক্টর। বন বিভাগের সরাসরি আওতায় ১.৫২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে। অশ্রেণীভুক্ত বন, গ্রামীণ বন এবং চা ও রাবার বাগান বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণভুক্ত নয়। অর্থাৎ সমগ্র দেশের ভূমির ১০.৩০ শতাংশ ভূমি বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রতিদিন বৃক্ষ নিধনের ভয়াবহ তথ্য জানতে পেরে শিউরে উঠছে দেশবাসী। শুধু অর্থের লোভে পড়ে কোনো মানুষ বনভূমি উজাড় করে ফেলতে পারে! জীবনে কত টাকার প্রয়োজন একজন মানুষের? সত্যিই কি এখনো ৭ ভাগ বনাঞ্চল আছে আমাদের দেশে? নাকি তা আশঙ্কাজনকভাবে আরো অনেক নিচে নেমে গেছে? নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে এক সময়ের নদীপ্রধান বাংলাদেশ এখন মরা নদীর দেশ। উজানের বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় পলি পড়ে পড়ে নদীগুলো আরো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বৃক্ষকেন্দ্রিক পেশা বা জীবিকাগুলো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে আরো অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল, এভাবে বনভূমি উজাড় হতে থাকলে আমাদের এই প্রিয় ব-দ্বীপটিই হয়তো একদিন বিপন্ন হয়ে পড়বে। কাজেই এদেশ ও এদেশের জনগণের যে কোন মূল্যেই বনখেকোদের রুখতে হবে। আমাদের যেসব বন ও বনজসম্পদ আছে তা সংরক্ষণ করা এবং সামাজিক বনায়নে দেশব্যাপী যে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে তাকে ধরে রেখে উত্তরোত্তর গতিশীল করার মধ্যে আমাদের সাফল্য নিহিত। যে কোন সময়ের তুলনা বন বিভাগে বর্তমানে সুশাসন শৃঙ্খলা বিরাজমান। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নতুন উদ্যোগ-উদ্দীপনা প্রয়োজন। তারা জনগণ ও সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডার সম্পৃক্ত করে বন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে ব্রতী হবেন-এটাই প্রত্যাশা। দারিদ্র্য বিমোচন, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের বন ও বনজ সম্পদ রক্ষা এবং সম্প্রসারণে সবার সম্মিলিত ভূমিকা সময়ের দাবি। লেখক : প্রাবন্ধিক কলামিস্ট। 

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়