Saturday, June 1

গানই তার প্রাণ,গানই তার জীবন জীবিকা


শ্রীকান্ত পাল,জকিগঞ্জ
গানই তার নেশা, গানই তার প্রাণ, গানই তার পেশা, গান নিয়েই তার সকল কাজ কর্ম, গানেই তার ধ্যান জ্ঞান, জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। অবসরে যেখানেই বসেন হাতের কাছে যা পান, তা দিয়ে টুং টাং করেই সুর ধরেন... আমি আপন জেনে ডাকিব আর কারেরে/ হায়রে প্রভূ অখিলের নাথ/ বিরহেতে না ছাড়িও মোবে..........। অপার মহিমা তোমার লীলারে/ বন্ধু প্রাণধন কালা/ তোমার পিরিতে ভীষন জ্বালা/.............। শাহ শিতালংশাহের গানসহ এমন অসংখ্য গান রয়েছে তার সংগ্রহে। স্বরচিত গানও ফুটে উঠে তাঁর কন্ঠে এমন একটি গান হলো- নুরে আলম বাবা এসকে জালালী/ ছিলছিলায়ে ফুল ফুটাইলেন কিবলা (শাহে) ফুলতলী/ বদরপুরীর ভান্ডারের ধন পাইলেন ফুলতলী/ প্রেম সাগরে ডুব দিয়াছে যারা আল্লার অলী/.................।
চোখে ভারী কালো চশমা। মাথায় লম্বা চুল। গায়ে পাঞ্জাবী। হাতে বেহালা। পথ চলেন অনূমানে। লোক চিনেন কন্ঠ শুনে। এলাকার সবাই থাকে মিরা বাউল হিসেবেই চিনে। জন্মান্ধ না হলেও জন্মের মাত্র পাঁচ
মাস বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন প্রতিভাবান মিরা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিরার উপরই পাঁচ সদস্যের সংসারের ভার। 
হাতের ছোয়াতে টাকা পয়সা গুনা, নিত্যদিনের বাজার সদাই, পথচলা সবই পারেন তিনি। এমনকি হাতের ছোয়াতে মোবাইলও চালাতে পারেন তিনি।  
২০/২২ বছর পূর্বে জকিগঞ্জের খলাছড়া ইউনিয়নের হামিন্দপুরের শিক বীরেশ চন্দ্র রায়ের সাথে পরিচয় হয় তার। তারই আগ্রহে জকিগঞ্জে আসেন বাউল মিরা। জকিগঞ্জের জ্যোৎøা রানী বিশ্বাসের সাথে পরিনয়ে আবদ্ধ হন। তিনটি সন্তান রয়েছে মিরার। নিজে পড়া শোনা না করলেও বাচ্চাদের পড়াতে খুবই আগ্রহ থাকলেও অভাবের সংসারে সেই সাদ পুরণ হয় না। বড় মেয়ে মিতা রানী বিশ্বাস ৮ম শ্রেণীতে, ২ বছর আগে বড়ছেলে মৃদুল কান্তি বিশ্বাস ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার সময় অসচ্ছলতার কারণে ভর্তি করতে পারেননি। সে দৈনিক ৩০ টাকা বেতনে ওয়ার্কসপে কাজ করে। ছোট ছেলে চয়ন বিশ্বাস ৩য় শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। মিরা বলেন “দয়ালে আমারে বাঁচাইয়া রাখলে যতই কষ্ট হয় এক ছেলে এক মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যাব।” ছেলে মেয়েদের মূখে এখন দু’মুটো ভাত তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মিরা বাউল সেখানে তার এ স্বপ্ন কতটুকু পুরণ হবে।
বড় কষ্টে আছেন জকিগঞ্জের সকলের প্রিয় দৃষ্টিহীন মিরা বাউল। গান শুনে যে যা বখশিস দেয় তা দিয়েই চলে তার সংসার। গ্রামাঞ্চলে একসময় বাউল গানের আসর বসলেও বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বাউল গানের আসর তেমন জমে উঠেনা। এক সময় তার যথেষ্ট কদর থাকলেও এখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে তার সংসার। কেমন আছেন ? জিজ্ঞেস করলে মিরা বাউল বলেন, বড়ই কষ্টে আছি।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সীমান্তিকের দেয়া বেহালাই তার বড় সম্বল। আত্বসম্মানবোধের কারণে কখনো কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি। বাদ্য যন্ত্র ছাড়াও গান করে শ্রোতা টানার অসাধারণ মতা আছে তার। হাতের কাছে যখন যা পান আঙ্গুল দিয়ে তাতে টুং টাং করে গাইতে থাকেন গান। গানের টানে ছুটে আসে মানুষ জমে উঠে আসর। 
গান কিভাবে শিখলেন? জিজ্ঞেস করলে মিরা বলেন আমার পৈত্রিক বাড়ী  বালাগঞ্জে সচি চন্দের কাছে তবলার তালিম নেই সেই ছোট বেলায়।  দূরবীন  শাহর ছাত্র ওয়ারিশ বাউল আমার গনের উস্তাদ । সাড়ে তিন বছর ক্বারী আমির উদ্দীনের সাথে কাটিয়েছি। গর্ব করে মিরা বলেন গণি সরকার, আকলিমা, আরিফ দেউয়ান সবাই তাকে চিনেন। বাউল সঙ্গীত, দেহ তত্ত্ব , মালজোড়া, নবী ও কৃষ্ণের জীবনী মিরার গানের বিষয়। শীতালংশাহ, দূরবীনশাহ, আরকুম শাহ, করিম শাহর গান বরাবরই মিরার প্রিয়। বেশ কয়েকটি গানের গীতিকারও তিনি।  বিশ বছর ধরে গানের জগতে বিচরণ মিরার । মিরার গানের যাদুতে আকৃষ্ট হয়ে তার সাথে ঘর বাঁধেন জোৎসনা রাণী বিশ্বাস। ভালবাসার মানুষকে নিয়ে পনের বছর ধরে জকিগঞ্জ উপজেলার খলাছড়া ইউনিয়নের হামিন্দপুর গ্রামে শ্বশুরালয়ে বাস করছেন এই গুণী শিল্পী। এক সময় কুশিয়ারা শিল্পী গোষ্ঠির সাথে সম্পৃক্ততা ছিল তার।
সাংবাদিক বদরুল হক খসরু বলেন, সুযোগ সুবিধার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছেন এই অসাধারণ প্রতিভাবান এই শিল্পী। এই গুনী শিল্পীকে প্রতিভা বিকাশে সরকারী বেসরকারী সহায়তা প্রয়োজন।
মিরা ভক্ত জকিগঞ্জ প্রেসকাব সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের চৌধুরী বলেন, মিরা এক অসাধারণ প্রতিভার নাম।  সুযোগ পেলে মিরা প্রতিভার প্রমান দিতে পারতো।
গীতিকার ও সুরকার মিরা বলেন, আমি অন্ধ হলেও আমার মনের চোখ খোলা। সেই চোখ দিয়েই আলো ছড়াতে চাই সর্বত্র।  জাতীয় প্রচার মাধ্যম বা কোন চ্যালেনে তার গান প্রচারিত হলে নিজেকে স্বার্থক মনে করবেন তিনি। 


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়