Thursday, October 9

নীরব সাধনায় দীপ্ত বাউল দেওয়ান কালা মিয়া


✍️ মিলন কান্তি দাস:

বাউল সংগীত: আমাদের আত্মার সুর

সংগীতের একটি অনন্য শাখা হলো বাউল সংগীত-যা মানুষের হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয়, আনন্দ ও শান্তিতে ভরিয়ে তোলে মনকে। বাংলাদেশ আউল-বাউলের দেশ; হাজার বছরের সংগীত সাধনায় এই মাটিতে গড়ে উঠেছে বাউল ঐতিহ্যের এক গভীর শেকড়।

বিশেষত সিলেট অঞ্চল বাউল ও মরমী সংগীতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। হাছন রাজা, রাধারমন দত্ত, শাহ আব্দুল করিম, ক্বারী আমীর উদ্দিন, শীতালং শাহ-এইসব কিংবদন্তিরা শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক সংগীত জগতেও উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিলেটের মাটি থেকে জন্ম নিয়েছেন আরও বহু বাউল, গীতিকার ও মরমী সাধক।

ধর্মপ্রাণ এই সিলেটের মাটিতে যেমন আধ্যাত্মিকতা, তেমনি মরমী সংগীতের প্রতিও রয়েছে মানুষের নিবিড় অনুরাগ।

কানাইঘাটের ধর্মপ্রাণ মাটিতে এক শিল্পীর জন্ম

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা-ধর্মপ্রাণ ও রক্ষণশীল সমাজের জন্য সুপরিচিত। এখানে সংগীতচর্চার তেমন পারিবারিক উৎসাহ বা প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না থাকলেও, এই মাটিতেই জন্ম নিয়েছেন এক অনন্য সংগীত সাধক-বাউল গীতিকার ও সুরকার দেওয়ান কালা মিয়া।


শৈশব ও শিক্ষা জীবন

কানাইঘাট পৌরসভার শ্রীপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৯ সালের ১১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন দেওয়ান কালা মিয়া। তাঁর পিতা মরহুম মাস্টার মুফজ্জিল আলী ছিলেন কানাইঘাট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং মাতা মরহুমা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান তিনি। ছোটবেলা থেকেই কণ্ঠস্বর ছিল মধুর ও আকর্ষণীয়। বাড়ির পাশের শিবনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি কানাইঘাটের দারুল উলুম দারুল হাদিস কৌমিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পরবর্তীতে শিবনগর ও কুওরের মাটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায়ও পড়াশোনা করেন। কিন্তু কৈশোরে পৌঁছেই সংগীতের প্রতি তাঁর টান ক্রমে গভীরতর হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে গান গাওয়া, গান শোনা-এভাবেই বেড়ে ওঠে তাঁর আত্মার সাধনা।

সংগীতের পথে যাত্রা শুরু

মাত্র ১৮ বছর বয়সে সংগীতের আহ্বানে ছুটে যান সিলেটের বিশিষ্ট গীতিকার সিদ্দিক আলী সাহেবের কাছে। সিদ্দিক আলী তাঁর কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হলেও পিতা-মাতার সম্মতি ছাড়া শিষ্যত্ব দিতে রাজি হলেন না। তবু সংগীতপ্রেমী এই তরুণের মনকে কিছুই থামাতে পারল না। আত্মার তাড়নায় তিনি আবারও সিলেট শহরে যান, আশ্রয় নেন তৎকালীন বিখ্যাত বাউল ওস্তাদ ফিরোজ মিয়া-র কাছে। ফিরোজ মিয়া তাঁর কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হয়ে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। টানা সাত বছর ওস্তাদের সান্নিধ্যে থেকে দেওয়ান কালা মিয়া হয়ে ওঠেন এক পরিপূর্ণ বাউল শিল্পী।

সংগীত জীবনের উত্থান

ওস্তাদের শিক্ষা শেষে তাঁর সংগীতজীবন আর থেমে থাকেনি। নব্বইয়ের দশকে বাউল সংগীত সিলেটসহ সারাদেশে ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। শাহ আব্দুল করিম, ক্বারী আমীর উদ্দিন, অন্নদা রঞ্জন দাস, আব্দুল খালিক প্রমুখের সঙ্গে তিনি এক মঞ্চে গেয়েছেন বহুবার। ক্বারী আমীর উদ্দিন তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁর প্রেরণা ও সান্নিধ্যে দেওয়ান কালা মিয়া হয়ে ওঠেন সিলেট অঞ্চলের এক স্বনামধন্য বাউল শিল্পী। এরপর থেকে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জসহ দেশের নানা স্থানে তিনি সংগীত পরিবেশন করেছেন। মানুষ মুগ্ধ হয়েছে তাঁর কণ্ঠে, মরমী সুরে ও গভীর গীতিতে।

৪০ বছরের সংগীত জীবনে তিনি অর্জন করেছেন মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও অগণিত প্রশংসা।

গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী হিসেবে উত্থান

দেওয়ান কালা মিয়া শুধু একজন শিল্পী নন-তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত সাধক। তাঁর গাওয়া গানগুলো বেশিরভাগই তাঁর নিজের লেখা ও সুর করা। বর্তমানে তাঁর দুই শতাধিক মৌলিক গান রয়েছে, যার বেশিরভাগই বাউল, মরমী, আধ্যাত্মিক ও দেশাত্মবোধক ধারার

🎵 জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান:

> “সুজলা সুফলা সবুজ শ্যামল

বাংলা মা, আমার প্রাণেরই প্রাণ

আমি বাংলা মায়েরই সন্তান…”

এই গানে মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা যেন প্রতিটি পঙক্তিতে অনুরণিত হয়েছে। এমন নিপুণ শব্দচয়ন কেবলমাত্র একজন প্রকৃত সংগীত সাধকের পক্ষেই সম্ভব।


🎶 সিলেট নিয়ে লেখা তাঁর জনপ্রিয় বাউল গান:


> “এই মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন শাহজালাল, শাহপরান

পূণ্যভূমি ধন্য আমি, সিলেট আমার জন্মস্থান।”


এই গানে তিনি সিলেটের প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতির চিত্রকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান প্রজন্মের বহু শিল্পীই এই গান পরিবেশন করে থাকেন।

ব্যক্তিজীবন ও মানবিক চিন্তাধারা

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক সন্তানের জনক। ধর্মপ্রাণ এই শিল্পীর জীবনে নৈতিকতা, অধ্যবসায় ও বিনয়ই তাঁর পরিচয়। তিনি চান তাঁর সন্তান যেন একজন সৎ ও শিক্ষিত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। শিক্ষক পিতা মরহুম মুফজ্জিল আলীর স্মৃতি তিনি আজও বয়ে বেড়ান। পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি শিক্ষকদের অবদান নিয়ে একাধিক গান রচনা করেছেন, যা ফেসবুক ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

দেওয়ান কালা মিয়া দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বেতার, সিলেট-এর তালিকাভুক্ত শিল্পী। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের অডিশনেও অংশগ্রহণ করেছেন এবং শিগগিরই তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে তাঁর নাম যুক্ত হবে বলে আশা করছেন অনুরাগীরা।

বর্তমানে তাঁর ইচ্ছা-চার দশকের সাধনার ফলস্বরূপ সৃষ্টিগুলো পুস্তক আকারে প্রকাশ করা, যা বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সংরক্ষিত থাকবে। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।

উপসংহার

দেওয়ান কালা মিয়া একজন অমিত প্রতিভাবান সংগীত সাধক-যিনি চার দশকের সংগীতচর্চায় নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। প্রচারবিমুখতার কারণে হয়তো তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি এখনো মেলেনি, তবে তাঁর শিল্পকর্মই তাঁকে অমর করে রাখবে।

বাঙালির চেতনা, মানবতা ও সংগীত ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে হলে দেওয়ান কালা মিয়ার মতো গুণী বাউল সাধকদের স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দায়িত্ব।কারণ, দেওয়ান কালা মিয়ার সংগীত বেঁচে থাকলে—বেঁচে থাকবে আমাদের বাঙালি চেতনা, সংস্কৃতি ও জাতীয় আত্মপরিচয়।

🖋️ লেখক: মিলন কান্তি দাস

(সাংবাদিক ও সাহিত্য অনুরাগী)


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়