মিলন কান্তি দাস ::
ক্যালিগ্রাফি। আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি বিষয়, প্রিয় একটি শিল্প, প্রিয় একটি জগৎ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল ও মননশীল মানুষেরা এই জগতের বাসিন্দা। ক্যালিগ্রাফি শিল্পে যারা শিল্পী হিসেবে কাজ করেন, তারা সত্যিই এক অনন্য উচ্চতার মানুষ। তাদের সৃজনশীলতা আমাকে অভিভূত করে। আমি সৃজনশীল মানুষকে গভীর শ্রদ্ধা করি-এই শ্রদ্ধা হৃদ্যতার, আন্তরিকতার।
এই পৃথিবীতে “সম্মান” একটি আবেগিক বিষয়-এক দুর্লভ সম্পদ, যা কখনও আর্থিক মূল্যে পরিমাপ করা যায় না। সম্মান কোনো বস্তু নয়, এটি মানুষের হৃদয় থেকে উৎসারিত অমূল্য অনুভূতি। ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা সেই সম্মানের মানুষ-যারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার অক্ষরকে নান্দনিক রূপে, শৈল্পিক প্রকাশে জীবন্ত করে তোলেন। এটি এক অনন্য সৃজনশীলতা, নৈপুণ্য ও নান্দনিকতার মেলবন্ধন।
যিনি ক্যালিগ্রাফি করেন, তিনি কেবল শিল্পী নন, তিনি একজন অনন্য মানুষ-সাধারণ আচ্ছাদনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অসাধারণ এক সত্তা। তার পোশাকে, তার চলায়, তার বলায়-থাকে শৈল্পিকতার ছোঁয়া, মাধুর্য ও গাম্ভীর্য। একজন মানুষের এর চেয়ে সুন্দর গুণ আর কী হতে পারে?
আমার পরিচিত অনেক ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আছেন, যারা একই সাথে বহু বিষয়ে পারদর্শী। তাদের সৃজনশীলতা, শৈল্পিকতা ও মৌলিক কর্ম আমাকে প্রতিনিয়ত বিমুগ্ধ করে। তারা শুধু আমার নয়, সমাজেরও শ্রদ্ধা ও প্রশংসার পাত্র। তাদের অনেকেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।
আমার জন্মস্থান সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলা। এখানকার প্রান্তরজুড়ে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য সাধারণ মানুষের ভিড়ে কিছু অসাধারণ মানুষ-কিছু সৃজনশীল, শৈল্পিক ও মৌলিক প্রতিভা। ক্যালিগ্রাফি শিল্পেও রয়েছেন এমন কিছু সৃষ্টিশীল মনের মানুষ। আজ আমি সংক্ষেপে এমন দুইজন গুণী ক্যালিগ্রাফি শিল্পীর কথা উল্লেখ করতে চাই। এটি কেবল প্রশংসা বা বন্দনা নয়-এ আমাদের দায়বদ্ধতা, এক প্রয়াস বর্তমানকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার ও তাদের অনুপ্রাণিত করার।
প্রথমজন চিত্রশিল্পী ভানু লাল দাস। তিনি কানাইঘাট পৌরসভার বিষ্ণুপুর গ্রামের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে শিল্পচর্চায় নিজেকে নিবেদন করেন। চিত্রকর্মের পাশাপাশি ক্যালিগ্রাফিতেও তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে একক চিত্র ও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন,এর মধ্যে সিলেটের কেমুসাসে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।
একজন চারুকলার শিক্ষক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন সিলেটের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলার্সহোমে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি একজন সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী ও সফল উদ্যোক্তা। তিনি “লাবণ্য সিতি ফাউন্ডেশন”-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়মিত এলাকার গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
দ্বিতীয়জন হলেন তরুণ শিক্ষক ও ক্যালিগ্রাফার জাহেদ হোসাইন রাহীন। তিনি কানাইঘাট উপজেলার ৮নং ঝিঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের তিনচটি গ্রামের বাসিন্দা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রাহীন একাধারে শিক্ষক, ক্যালিগ্রাফার, চিত্রশিল্পী, প্রচ্ছদ শিল্পী, ফুটবল রেফারি ও অনুষ্ঠান উপস্থাপক। এখন পর্যন্ত তিনি শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন, যার অনেকগুলোতেই নিজস্ব ক্যালিগ্রাফি যুক্ত করেছেন। তার সৃজনশীলতা ও নিষ্ঠার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একাধিকবার উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।
পরিশেষে বলা যায়,ক্যালিগ্রাফি কেবল একটি শিল্প নয়, এটি এক উন্নত মননশীলতার প্রকাশ। যারা এই শিল্পচর্চা করেন, তারা নন্দন ও আদর্শ জীবনদর্শনের অনুগামী। কানাইঘাটে এমন আরও অনেক ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আছেন, যাদের প্রত্যেকেই শ্রদ্ধা ও প্রশংসার যোগ্য। সময়ের সীমাবদ্ধতায় সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হলো না, তবুও আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সবার জন্য সমানভাবে নিবেদিত।
তাদের সৃষ্টিশীল কর্মে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক কানাইঘাট, বিকশিত হোক এই মননশীল শিল্পের চর্চা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়-এই কামনাই রইল।
লেখকঃ মিলন কান্তি দাস,কবি, কলামিস্ট ও গীতিকার

0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়