কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
গোবিন্দ আর যোগিন্দর দুই ভাই। "ছুটির দিনে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা থাকে", বলছিলেন ৩৪ বছর বয়সী গোবিন্দ। দিল্লির কাছাকাছি এই উপশহরের কাঁচ এবং কংক্রিটের ধূলোবালিময় সেই স্থানে তার আশেপাশে বস্তা-ভর্তি পত্রিকার পাতা, কাগজ, মেটাল, কাঁচ, প্লাস্টিক এবং আরও অনেককিছু। সেখানে আছে পুরনো বাতিল সুটকেস, কিছু বাইসাইকেল ইত্যাদিও।
শিপ স্ক্র্যাপ ডিলার এর মালিক গোবিন্দ এবং তার ভাই যোগিন্দর। ১০ বছর ধরে তারা এইসব হাবিজাবি সংগ্রহ করছেন। অন্যান্য লোকেরা যেসব জিনিস শেষপর্যন্ত ব্যবহার করে আর মূল্যহীন মনে করে ফেলে রেখে গেছে সেগুলো থেকেই তারা কিছু না কিছু বের করে আনছে।
বড় ভাই যোগিন্দর বলছেন, "সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব পরিত্যক্ত আবর্জনার ধরনও বদলে গেছে। এখন সব কিছুই হালকা ধরনের, আগের তুলনায় এখন প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বেশি। রূপার বদলে জায়গা নিয়েছে তামার তার।"। তিনি বলেন গড়ে প্রতিমাসে তাদের আয় হয় ৩০,০০০ রুপি।
এই মাঠেই সব কাজ চলে খোলা আকাশের নিচে। সবুজ পাতাময় গাছপালা প্রখর রৌদ্র-তাপ ঢেকে দেয়। তবে ঢেউটিন সেখানে কাগজ রক্ষায় সাহায্য করে।
ভারতীয় দুই ভাই বিবিসিকে বলছেন, এইসব ফেলনা বস্তুর মূল্য হাজার হাজার ডলার। এক কোনায় একটি কেরোসিনের চুলা রয়েছে যেখানে রাতে প্রয়োজনের খাবার বানিয়ে খাওয়া সম্ভব। কখনো কখনো তাদের দুই ভাইকে এখানে রাতেও থেকে যেতে হয়। সে সময় তারা ছোট্ট বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে নিতে পারেন।
যোগিন্দর বলছেন, অনেকের কাছে ফেলনা এইসব জিনিস বহু ডলার মূল্যের, ভারতের জন্য ভবিষ্যৎ । স্ক্র্যাপ ডিলারদের বলা হয় কাবাডিওয়ালা আর রাডডিওয়ালা-তারা ভারতের, প্রধানত অনানুষ্ঠানিক কিন্তু শক্তিশালী, পুনঃব্যবহারযোগ্য শিল্পের অন্তর্ভুক্ত।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কোম্পানি ওয়েস্ট ভেঞ্চারের প্রতিষ্ঠাতা রোশান মিরান্ডা বলেন, ভারতের অনেক শহরেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে এভাবে আবর্জনা সংগ্রহ করা হয় না।
কিন্তু অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতীয়রা অনেক বেশি বর্জ্য উৎপাদন করছে কারণ প্রক্রিয়াজাত খাবার রান্নাঘরের জায়গা দখল করেছে। এছাড়াও রয়েছে তাক ভরা সস্তা বৈদ্যুতিক সামগ্রী আর ফোনে `ফ্রি হোম ডেলিভারি সুবিধা` সম্বলিত অ্যাপ। ফলে অনানুষ্ঠানিক আবর্জনা সংগ্রহকারীদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে।
ভারতীয় সরকারের হিসাব অনুসারে ৬২ মিলিয়ন টন উৎপাদন করে ভারত কিন্তু এর সংগ্রহ করা, বিভিন্ন প্রকারের বাছাই এবং বিক্রি করার সঙ্গে কতজন যুক্ত আছে তার পরিষ্কার কোনও পরিসংখ্যান নেই।
গোবিন্দ স্কুল শেষ করলেও কখনো কলেজে যাননি। নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে যাদের বয়স ১৩ এবং ১০ বছর। তাদের নিয়ে কাছেই এক গ্রামে বাস করেন তিনি। তার তার আগে শুরু করেছেন এই ব্যবসা।
এখন তার রুটিন হলো প্রতিদিন সকাল নয়টায় শুরু করা এবং আটঘণ্টা ধরে বাড়িতে বাড়িতে কলিং-বেল বাজিয়ে প্রায় ১০০র মতো বাড়ি থেকে ফেলনা সংগ্রহ করেন।
এখন তার রুটিন হলো প্রতিদিন সকাল নয়টায় শুরু করা এবং আটঘণ্টা ধরে বাড়িতে বাড়িতে কলিং-বেল বাজিয়ে প্রায় ১০০র মতো বাড়ি থেকে ফেলনা সংগ্রহ করেন।
ভারতে পুনঃনবায়নে জন্য আমাদের সবকিছু কিনতে হয়। কিন্তু অন্যান্য দেশে আপনি টাকা খরচ করলে কেউ এসে পুনঃনবায়নের পিক আপ করবে, গোবিন্দ তার কিছু বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে এমনটা জানতে পেরেছেন বলে জানান।
তার ভাণ্ডারের জিনিসপত্রের ভেতরে ৮০ শতাংশই খবরের কাগজ, প্রতি সপ্তাহ সে ২০০০ কিলোগ্রাম খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, বই, কার্ড-বোর্ড, সংগ্রহ করে। তবে পুনঃব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে এটাই সবচেয়ে সস্তা। এক কিলোগ্রামের দাম ১২ রুপির মতো যা এক ডলার বার এক পাউন্ডের কম।
‘আমরা খুব কমই প্লাস্টিক পাই কারণ এগুলো আবর্জনার সঙ্গে ফেলে দেওয়া হয়। আমরা যেগুলো পাই তা পরিচ্ছন্ন।’ ভারতে যারা বর্জ্য সংগ্রহ করেন তাদের ধরন দুই রকম। ‘পরিষ্কার বর্জ্য’ সংগ্রহকারী যেমন গোবিন্দ যারা পুনঃনবায়ন যোগ্য বিভিন্ন দ্রব্য সংগ্রহ করেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। আরেক দল হলো আবর্জনা সংগ্রহকারী যারা ডাস্টবিন, রাস্তাঘাট, ডোবানালা ভরাটের জন্য ফেলা আবর্জনা থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে।’
বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা আবর্জনা খুঁজে আনেন তারা নিজেদেরকে রাস্তাঘাট থেকে যারা আবর্জনা সংগ্রহ করেন তাদের চেয়ে উচ্চ শ্রেণির বলে মনে করেন।
হিন্দু ধর্মানুসারীদের সবচেয়ে উঁচু জাত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোক হওয়া সত্ত্বেও এই কাজকে ছোট করে দেখতে রাজি নন গোবিন্দ। ছুটির দিনগুলোতে সে একটি স্কুলের বাসের চালক হিসেবে কাজ করে।
তার ভাগাড়েতে সব সময় লোকজনের আনাগোনা। বিভিন্ন জায়গা থেকে নানান জিনিস খুঁজে নিয়ে আবর্জনা সংগ্রহকারীরা আসে তাদের জিনিসপত্র বিক্রি করতে। আশেপাশের অনেক লোকজনও আসে তাদের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে। অনেক লোক আবার পুরাতন আসবাব কিনতে আসেন ।
যোগিন্দর বলেন ‘এটা একটা দোকানের মতো, যে কেউ যেকোনো সময় এসে জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারে।’ এই কেনাবেচার পর শুরু হয় আসল কাজ। কাগজপত্র চলে যায় দিল্লির পালাম উপশহরের একটি গুদামে।
এরপর তার মূল ঠাঁই হয় প্রতিবেশী উত্তর প্রদেশের কারখানায়। মেটাল চলে যায় পশ্চিম দিল্লি, যেখানে ভারতে ধাতব আবর্জনার সবচেয়ে বড় বাজার। প্লাস্টিক দ্রব্য গুরগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায়। আর ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-ওয়েস্ট চলে যায় উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিখ্যাত সিলামপুরে।
কখনও কখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও মিলে যায়, জানান দুই ভাই। যোগিন্দর বলেন, এয়ার পিউরিফায়ার কিংবা ছোটখাটো এয়ার কন্ডিশনারও।
এই কাজের ঝুঁকিও কম নয়। গোবিন্দ কয়েকবার তার জখমের শিকার হয়েছেন। তিনি শুনেছেন একজন আবর্জনা সংগ্রহকারী যখনই কুড়িয়ে পাওয়া কাঁচের বোতলের মুখ খুলেছে তৎক্ষণাৎ এর ভেতর থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক বেরিয়ে এসে তার গায়ের চামড়া পুড়ে গেছে।
অনেক সময় প্রচুর ছবিও পাওয়া যায়, যার মধ্যে অনেক বিয়ের ছবিও থাকে। কিন্তু তা দিয়ে এই আবর্জনা সংগ্রহকারীরা কী করবেন? ‘কাগজের সঙ্গে সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর তো উপায় নেই।’
যোগিন্দর বলেন, খেলার সামগ্রী, খেলনা এমনকি রোলার স্কেটও বিক্রি করেন বাচ্চাদের কাছে। কিছু জিনিস তারা বাড়িতেও নিয়ে যান যেমন কুড়িয়ে পাওয়া এয়ার কন্ডিশন নিয়ে নিজের বাসায় লাগিয়েছেন।
অনেক সময় ডায়াপারও একই ব্যাগে করে লোকজন দিয়ে দেয় উল্লেখ করে সেসব বিব্রতকর বলে জানান যোগিন্দর। এছাড়া এমন কিছু দেওয়া হয় যার কথা তিনি নিজের মুখে বলতে চাইলেন না, তবে অনুমান করা যায় তিনি স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথাই বলছিলেন। তবে এটা তাদের খুব একটা রাগান্বিত করতে পারে না। কারণ তারা মনে করেন এটা তাদের ব্যবসা।
খবর বিভাগঃ
বিশেষ খবর
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়