রাজনীতিবিদসহ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের বইপড়ার অভ্যাস খুবই কম। জাতি হিসেবে আমরা বই পড়ায় অনেক পিছিয়ে। লেখাপড়ার সঙ্গে যদি সনদপত্রের সম্পর্ক না থাকত কিংবা যদি পাস-ফেলের ব্যাপারটা না থাকত; তাহলে বহু বাঙালি বই ছুঁয়েও দেখত না। দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই তুলনায় বইপড়ুয়া মানুষের সংখ্যা বাড়েনি। এটা হতাশাব্যঞ্জক। জেলায় জেলায় গণগ্রন্থাগার রয়েছে। অনেক উপজেলায়ও আছে। এসব গণগ্রন্থাগারের অবস্থা ভালো নয়।
সেখানে পাঠকের উপস্থিতি যারপরনাই কম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি ইত্যাদি দিক থেকে বহু পিছিয়ে পড়া জাতিও আমাদের থেকে উন্নতি করেছে। এসব জাতির পাশাপাশি উন্নত জাতিগুলোর অবস্থা আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব উন্নত দেশে শিক্ষার হার বেশি, পাশাপাশি বইপড়ুয়াদের সংখ্যাও অনেক বেশি। অনেক উন্নত দেশে বই লেখা লাভজনক পেশা। কত বেশি পড়ুয়া থাকলে পরে এটা সম্ভব হয়। পড়া ও জানার বিষয়টি এসব উন্নত দেশকে এগিয়ে দিয়েছে, আর আমরা পিছিয়ে আছি না পড়া ও না জানার কারণে।
রাজনীতিবিদদের বেশি সময় কাটে মাঠে-ঘাটে, গৃহের বাইরে। বই পড়ার সময় কই? কিন্তু আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশের পরিচিত-আলোচিত রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব সুপরিচিত ও বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের বই পড়ার অভ্যাস ছিল খুব বেশি। বই-ই তাদের বিখ্যাত রাজনীতিবিদে পরিণত করেছে। রাজনীতির শীর্ষ পদে আরোহণ করেও বই পড়া বাদ দেননি। এমনকি ক্ষমতার চেয়ারে থাকার সময়ও।
হিলারি ক্লিনটন বর্তমান বিশ্বের একজন আলোচিত রাজনীতিবিদ। প্রায় দুই দশক ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের একজন। দীর্ঘদিন ছিলেন সিনেটর। তিনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী ও ফার্স্টলেডি ছিলেন। ছিলেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মহিলার বেডরুমে একগাদা বই জমা থাকে রাতে পড়ার জন্য। তার নিজের ভাষ্য, ‘সাধারণত আমি একসাথে একাধিক বই পড়ি’।
‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস্’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ভ্রমণ করার সময় আমাকে একগাদা ফাইল দেয়া হতো প্রত্যেকটি জায়গা বা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে। তাই ওই ফাইলপত্র পড়াতেই আমার অধিকাংশ সময় চলে যেত। কিন্তু সময় পেলে আমি একটি উপন্যাস বা ওই জায়গাকে নিয়ে কোনো ভ্রমণকাহিনী পড়ার চেষ্টা করতাম।’ তার স্বামী বিল ক্লিনটন যে কত বেশি বই পড়তেন তা বোঝা যায় তার এই উক্তিতে- ‘রাজনীতিবিদের কাজ কীভাবে আরো ভালো করে করা যায় তা জানার জন্যই বরং আমি অনেক বই পড়েছি।’
অফিসের টেবিলে, ইজি চেয়ারে বসে, খাটে শুয়ে বা প্লেনেও তিনি বই পড়েন। বারাক ওবামাও অনেক বেশি বইপড়ুয়া। বিভিন্ন উপলক্ষে ওবামা পরিবারে বই কেনার একটা রেওয়াজ রয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রতিবছরই বই কিনতে তিনি তার পরিবার নিয়ে বইয়ের দোকানে যেতেন। প্রচুর বই কিনতেন। আমেরিকার মতো ক্ষমতারধর দেশের প্রেসিডেন্টদের যেখানে বই পড়ার এমন অভ্যাস, তৃতীয় বিশ্বে এমনটি কল্পনা করাও কঠিন।
শুধু বিখ্যাত রাজনীতিবিদ নয়, পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের অনেকের বই পড়ার অভ্যাস জানলে অবাক হতে হয়। বিল গেটস, যার প্রতি মিনিটে আয়কৃত সম্পদের পরিমাণ ২২,৯৪৬ ডলার। এই মানুষটি সপ্তাহে একটা করে বই পড়া শেষ করেন। বছর শেষে তিনি পড়ে ফেলেন ৫০টার মতো বই। প্রতিবছর তিনি তার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন ওই বছরে তার পঠিত সেরা দশটা বই। এত বড় মাপের একজন ব্যবসায়ী কতটা সময় ব্যয় করেন শুধু বইয়ের পেছনেই, ভাবতেই অবাক হতে হয়। মার্ক জাকারবার্গও বিল গেটসের মতো বইপড়–য়া মানুষ। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি প্রতি দুই সপ্তাহে একটা করে বই শেষ করে ফেলেন।
উপমহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই পড়ুয়া ছিলেন। তারা জীবনে প্রচুর বই পড়েছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো ব্যস্ত রাজনীতিবিদের দৈনিক কয়েক ঘণ্টা সময় কাটত বই পড়ে। এমনকি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও রোজ সেদিনের সংবাদপত্র এবং তার প্রয়োজনীয় বইপত্র নিয়ে সকালে অন্তত দুই ঘণ্টার জন্য একান্ত রুমে ঢুকতেন। এ সময় কাউকে তিনি সময় দিতেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে থাকাবস্থায় অনেক বই পড়েছেন এবং নিজের আত্মজীবনীও লিখেছেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর জীবনের বড় সময় কেটেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত থেকে আর শাসন ক্ষমতায় আসীন থেকে।
এই অতি ব্যস্ত মানুষটি ভালোপড়ুয়া ছিলেন। জেলে বসেই বিশ্বের সেরা বইগুলো পড়েছেন। সেখানেই লিখেছিলেন বিখ্যাত কয়েকটি বই। ‘পৃথিবীর ইতিহাস’সহ বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, রাজনীতির পাশাপাশি কত যে সময় তিনি বই পড়ায় ব্যয় করেছেন। ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ বইটি তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা অনেকগুলো চিঠির সমষ্টি। চিঠিগুলো লিখেছিলেন কারান্তরাল থেকে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। ইন্দিরার বয়স তখন খুবই কম ছিল। সেই চিঠিগুলো ব্যক্তি ও সময়কে ছাড়িয়ে হয়েছে সার্বজনীন, সর্বকালীন। বিচিত্র ইতিহাসের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। প্রচুর বই না পড়লে এত বিখ্যাত বই রচিত হতে পারত না জওহরলাল নেহেরু কর্তৃক।
আব্দুল মনসুর আহমদ মন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন বিখ্যাত ও ব্যস্ত রাজনীতিবিদ। তারপরও প্রচুর বই পড়তেন। অনেক বেশি লেখাপড়া করতেন বলে তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, ‘আয়না’, ‘হুযুর কেবলা’ ইত্যাদি বইগুলো বিখ্যাত হয়েছে। তার সমসাময়িক অনেক রাজনীতিবিদ আব্দুল মনসুর আহমদের মতো স্মরণীয়-বরণীয় হতে পারেননি, কারণ আব্দুল মনসুর আহমদ বই পড়ে ও বই লিখে অমর হয়ে আছেন। উপমহাদেশের বিখ্যাত নেতা মহাত্মা গান্ধী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজি সুভাস বসু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, আবুল হাশেম, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী-এরা প্রচুর বই পড়তেন। জেলের ভেতর, ভ্রমণের সময় এবং গভীর রাতে এরা বই পড়তেন। এসব রাজনীতিবিদের অনেকের লেখা বই প্রচুর জনপ্রিয় এবং আজও বহুল পঠিত।
অনেকেই হয়তো জানেন, আমাদের জাতীয় সংসদে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ধরনের ৮৬ হাজারের মতো বই আছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নাল-সাময়িকী আছে। এত সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরির পাঠক সংখ্যা যারপরনাই কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দশম সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ এমপি একবারের জন্যও যাননি বিশাল পরিসরের সুসজ্জিত এই গ্রন্থাগারে আর যারা গেছেন তাদের অনেকেই পত্রিকা পড়ে চলে আসেন। জাতীয় সংসদের লাইব্রেরির এমন চিত্র আমাদের হতাশ করে। আবার আশাবাদী হই এই ভেবে যে, এত বড় একটা লাইব্রেরি আমাদের জাতীয় সংসদে রয়েছে। এমপিরা ইচ্ছা করলেই সেখানে গিয়ে প্রচুর বিখ্যাত দেশি-বিদেশি বই পড়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারেন।
জাতি হিসেবে আমাদের আরো উন্নতি করতে হবে। পিছিয়ে থাকা চলবে না। উন্নতির প্রথম ও প্রধান সোপান সুশিক্ষিত হওয়া, যোগ্য হওয়া, দক্ষ হওয়া। এ জন্য প্রয়োজন বই পড়া, অনেক বেশি বই পড়া। বই পড়ে মানুষ জ্ঞানী হয়, তার মধ্যে প্রকৃত মনুষ্য গুণাবলি তৈরি হয়। তার মধ্যে থাকা অজ্ঞতা দূর হয়। নিজে যোগ্য হয়ে ওঠে, উদার হয়ে ওঠে। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত প্রতিদিন কিছু সময় বই পড়ার জন্য ব্যয় করা। আমাদের রাজনীতিবিদরা ব্যস্ত থাকেন রাজনীতির মাঠে। এই ব্যস্ততার মাঝ দিয়েও প্রতিদিন যদি কিছু সময় বরাদ্দ করেন বই পড়ায়, তারা নিজেরা তো উপকৃত হবেনই, জাতিও অনেক উপকৃত হবে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক: পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খবর বিভাগঃ
মতামত
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়