Wednesday, July 15

তাকওয়ার অনুশীলনে রোজা


মাওলানা বায়েজীদ হোসাইন সালেহ: আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামতের গণনা করো, তবে গুনে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ (সূরা ইবরাহিম : ৩৪)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, আমি মানব এবং জিন জাতিকে আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি। (সূরা জারিয়াত : ৫৬)। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত দিয়ে, সুন্দর অবয়বে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য। সত্য ও ন্যায়ের পথে চলে আলোকিত জীবন গঠন করার জন্য। জাহান্নামের পথ ছেড়ে জান্নাতি মানুষ হওয়ার জন্য। কিন্তু দুনিয়ার অন্ধ মোহে পড়ে মানুষ সত্য ও ন্যায়ের কথা ভুলে অন্যায় ও পাপের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। অন্তরে আল্লাহর স্মরণ বাদ দিয়ে শয়তানি স্বভাব লালনে সদা ব্যস্ত থাকে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রধান হাতিয়ার হলো খোদাভীতি। আরবিতে যাকে বলা হয় 'তাকওয়া'। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্বকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে তাকওয়ার কোনো বিকল্প নেই। লোকচক্ষুর আড়ালে, পুলিশি প্রহরা যেখানে অকার্যকর, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী যেখানে ব্যর্থ, স্যাটেলাইটের তীক্ষ্ন দৃষ্টি যেখানে একেবারেই অসহায়, সেখানেও আল্লাহর ভয় একজন ব্যক্তিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারে। অতএব, তাকওয়া হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, পাপমুক্ত লোকালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। তাকওয়া মূলত নিজের জন্য নিজেই প্রহরী। আর এ তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা, নিজেকে তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত করার শ্রেষ্ঠ সময় হলো মাহে রমজান। পবিত্র রমজান মাসের রোজাই পারে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ উপহার দিতে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা : ১৮৩)। সুতরাং রোজার অর্থই হচ্ছে তাকওয়ার অনুশীলন। আর তাকওয়ার অনুশীলনের অর্থই হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এক উচ্চাঙ্গের প্রশিক্ষণ। অনেক রোজা পালনকারীর প্রাণ ক্ষুৎ-পিপাসায় ওষ্ঠাগত হয়। সে গোপনে পৃথিবীর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, যথার্থ সুযোগ লাভ করেও পানি ও খাদ্যের দিকে হাত বাড়ায় না। সে অত্যন্ত কষ্ট স্বীকার করে। তাকওয়া নামক এ অতন্দ্র প্রহরীর সন্ত্রস্ততা তাকে এ শক্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করার মাধ্যমে বাস্তবে তাকওয়া সৃষ্টিতে রোজার যে বলিষ্ঠ ভূমিকা তা আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। বছরের অন্য যে কোনো মাসের চেয়ে পবিত্র রমজানে মানুষের মনে এ ভীতিটা বেশি কাজ করে যে, আমি যা করি আল্লাহ সব কিছু দেখছেন। আমার প্রতিটি কর্মই আল্লাহর দরবারে রেকর্ড হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে এই যে উপলব্ধি বা বোধোদয় এটা একটি বিশাল ব্যাপার। অথচ আল্লাহ তায়ালা সবসময়, সর্বদা, সবখানে আছেন, সব দেখেন, শোনেন, জানেন। হজরত লোকমান হাকিম প্রিয় সন্তানকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, যা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, হে বৎস! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা যদি থাকে পাথর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। (সূরা লোকমান : ১৬)। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় আমরা অন্য মাসে তা অনুধাবন করতে পারি না। অনুধাবন করতে পারি শুধু রমজান মাসে। আর এ উপলব্ধির কারণ হচ্ছে রোজা। অতএব রোজা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে। অন্তরে খোদাভীতি সুদৃঢ় করে। পাপ কাজের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা সৃষ্টি করে। নেক আমলে, ভালো কাজের দিকে মনকে ধাবিত করে। জীবনকে সত্য ও সুন্দর পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে মাহে রমজানের রোজা। রমজানে পারস্পরিক শক্রতা, হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে সবার মাধ্যে একতার সুর বেজে ওঠে। গরিব ও ধনীদের মধ্যে প্রভেদ কমে যায়। একে অপরকে সহজেই কাছে টেনে নেয়। বুকে জড়িয়ে ধরে পরম সুখ অনুভব করে। মোট কথা, সব সেক্টরে বদ অভ্যাস, বদ স্বভাব দূর হয়ে শান্তির সুবিমল বাতাস বইতে শুরু করে। সবার মনে আলাদা ভয় বিরাজমান থাকে। মৃত্যুর কথা বেশি স্মরণ হয়। গোনাহর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। পরকালীন জবাবদিহিতার মানসিকতা অধিক পরিমাণে জাগ্রত হয়। সবাই ভাবে, আমি রোজা রেখে যা করছি আল্লাহ সরাসরি প্রত্যক্ষ করছেন। তাই কোনোভাবেই অন্যায়-অপকর্ম করা যাবে না। রোজা রেখে এই যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা যদি সারা জীবন কোনো ব্যক্তি হৃদয়ের গহিনে সযত্নে লালন করে, আর রমজানের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে অন্ততপক্ষে এটা বলা যায় যে, এ সমাজ দেশ-জাতি দুর্নীতি ও দুঃশাসন মুক্ত হয়ে একটি সোনালী সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত হবে নিঃসন্দেহে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়