সারওয়ার কবির, লন্ডন, ১৩ মে ২০১৫ : টিউলিপ। পুরো নাম টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। জন্ম লন্ডনের মিচামে। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে। কাজ করেছেন এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, গ্রেটার লন্ডন অথোরিটি (জিএলএ) ও সেইভ দ্যা চিলড্রেন ফান্ড চ্যারিটি সহ আরো অনেক দাতব্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের হয়ে। লেবার পার্টির সাবেক লিডার এড মিলিব্যান্ডের লিডারশীপ ক্যাম্পেইনে কাজ করেন তিনি। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাচনী ক্যাম্পেইনেও অংশ নেন তিনি। ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে হ্যাম্পস্টেড এন্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবারপার্টির হয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর এই নাতনি। যে আসন থেকে নির্বাচিত হলেন টিউলিপ, সেই হ্যাম্পস্টেড কিলবার্নেই কেটেছে তার কৈশোর। এই এলাকার স্কুলে পড়েছেন। ২০১০ সালে তিনি স্থানীয় ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকির জ্যেষ্ঠ কন্যা মাস্টার্স ডিগ্রীধারী টিউলিপ সিদ্দিক মাত্র ১৬ বছর বয়সেই লেবার পার্টির সদস্য হন । ২০১৩ সালের জুলাই মাসে স্থানীয় পার্টির সদস্যদের ভোটে টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড এন্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবার দলের মনোনয়ন লাভ করেন। টিউলিপ সিদ্দিক ক্যামডেন এন্ড ইজলিংটন এনএইচএস ট্রাস্টের গভর্ণর, রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের ফেলো এবং কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সদস্য। স্থানীয় পত্রিকা হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেইট এক্সপ্রেসের নিয়মিত লেখক টিউলিপ সিদ্দিক। ব্রিটেনের প্রভাবশালী এক’শ বাঙালির তালিকায় নাম রয়েছে তাঁর। এতো বহুমূখী মেধা যার রয়েছে, এত কিছু যার নামের সাথে জড়িত, তিনি যে আমদের গর্ব তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিনি শুধু একজন প্রতিভাবান ব্রিটিশ রাজনীতিকই নন, তিনি সমগ্র বাঙালির অহংকার। তিনি বাঙালির জন্য সুনাম কুড়িয়ে এনেছেন। বঙ্গবন্ধুর নাতনি হিসেবে পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও মানসেবার দীক্ষাকে তিনি সূদুর বিলেতেও লালন করছেন সযতনে। জাতির পিতার রক্ত যার শরীরে বইছে তার মধ্যে এমন নেতৃত্বগুণ তো আশা করাই যায়। টিউলিপ বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী পরিবারের উত্তরসূরী সেটা ঠিক। কিন্তু তিনি নিজের মেধা, পরিশ্রম এবং দক্ষতা দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়েছেন। ব্রিটিশ রাজনীতিতে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। শুধুমাত্র পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা বললে ব্যক্তি টিউলিপের অসাধারণ মেধা ও প্রতিভাকে খাটো করা হবে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী, জামায়াত-বিএনপি এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা এই ব্রিটেনেও টিউলিপের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলো। টিউলিপের পারিবারিক পরিচয়ের কারণে তারা টিউলিপের বিরুদ্ধে আদা জল খেয়ে নেমেছিলেন। শুধু বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত হননি তারা, নিজেদের নোংরা রাজনৈতিক মুখোশকে ব্রিটেনে উন্মোচন করেন আরো ন্যাক্কারজনকভাবে। বিএনপি জামায়াত তাদের নোংরা রাজনীতিকে হ্যাম্পস্টেড-কিলবার্নে নিয়ে গিয়ে কি বাংলাদেশের জন্য সুনাম কিংবা সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছেন? নাকি তারা নিজেদের অপমানবোধটুকুও হারিয়েছেন? ব্রিকলেইন থেকে কয়েকজন বিএনপি ও জামায়াতপন্থী নেতা কিলবার্ন-হ্যাম্পস্টেড গিয়ে টিউলিপের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে শুধু নিজেদের মুখেই চুনকালি মাখাননি, ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের অপমানিত করেছেন। রুশনারা, টিউলিপ এবং রূপার জয় আমাদের জন্য গর্বের। সেখানে একজন বাঙালি প্রার্থীকে ঠেকাতে যারা হ্যাম্পস্টেড-কিলবার্নে গিয়েছেন তারা তাদের সঠিক জবাব পেয়েছেন টিউলিপের বিজয়ের মাধ্যমে। বৃটেনের এই নির্বাচনে লন্ডনের মধ্যে সবচেয়ে মার্জিনাল আসন ছিলো হ্যাম্পস্টেড এন্ড কিলবার্ন। ২০১০ সালের নির্বাচনে এ আসনে মাত্র ৪৫ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন লেবারের হয়ে অস্কারবিজয়ী অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন। প্রথমবার নির্বাচন করা টিউলিপের জন্য এমনতিইে ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। এ আসনে কনজারভেটিভের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এমনটিই ধারণা করেছিলো বৃটেনের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলো। তার উপর স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচার। স্থানীয় বাংলাদেশী ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে। সেখানে পবিত্র ধর্ম ইসলামকেও ব্যবহার করা হয়েছে টিউলিপ ভোট না দিতে। তাদের সকল অপপ্রচারের জবাব দেয়ারসেই মাহেন্দ্রক্ষণটি ছিলো ৮ মে ভোর রাত ৪ টা ৫৬ মিনিট। টিউলিপের ফলাফল ঘোষনার পূর্ব মুহুর্ত। ভোর রাত ৪ টা বেজে ৫৬ মিনিট। রিটার্নিং অফিসার যখন ঘোষনা করলেন বিজয়ী হিসেবে টিউলিপের নাম তখন আবেগাপ্লুত এক মায়ের চোখে পানি।
টিউলিপ তার বিজয়ী বক্তৃতা শেষে মা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানাকে ডাকলেন মঞ্চে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি সন্তানের সাথে ছবি তুলছেন মিডিয়ার লোকেরা। মঞ্চ থেকে যখন নামলেন শেখ রেহানা তখনও তার চোখে পানি। চোখ মুছলেন, জড়িয়ে ধরলেন বড় ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও ছোট মেয়ে রুপন্তী সিদ্দিককে। এ কান্না ছিলো বিজয়ের, এ কান্না ছিলো সুখের। আর তাই জাতির জনকের কন্যার প্রতিক্রিয়া ছিলো এভাবেই আমি গর্বিত পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গর্বিত বোন আর আজ থেকে আমার টিউলিপের মা। আমি মা হিসেবে খুব গর্বিত। এতো সুন্দর একটা মেয়েকে জন্ম দিতে পেরেছি। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। সন্তানের এতো বড় সাফল্য, মা হিসেবে এর চেয়ে বেশী আর কি হতে পারে। এই আনন্দের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের কথা ভুলেননি, তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি টেনে এনেছিলেন আজকে দুটো আনন্দ, ছিটমহল বিনিময় একটা ( মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) আরেকটি টিউলিপের জয়।
টিউলিপের বড় ভাই রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিক তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, টিউলিপের বিজয়ে আমি আনন্দিত। কিন্তু তার বিজয় ঠেকাতে নোংরা পলিটিক্স ঢুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে । টিউলিপ লোকাল ইস্যুতে পলিটিক্স করেছে, ব্রিটিশ ইস্যুতে পলিটিক্স করেছে। ওর নামে ইলিগ্যালভাবে লিফলেটিং করেছে বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা। কিন্তু এখানকার ভোটাররা তাদের মিথ্যা কথাকে প্রশ্রয় দেয়নি। দোয়া করবেন আগামী ৫ বছর টিউলিপ যাতে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে পারে। সন্ধ্যা রাত থেকেই পরদিন ভোর পর্যন্ত ক্যামডেন টাউন হলে টিউলিপের মা শেখ রেহানা, ভাই রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিক ও বোন রূপন্তী সিদ্দিক ভোটকেন্দ্রে ছিলেন উদ্বিগ্ন ,টিউলিপ ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। তার সেই আত্মবিশ্বাসই তাকে জিতিয়ে দিয়েছে। তাকে জয়ী করেছে। মর্যাদার আসনে বসিয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারকে। টিউলিপ বিলেতের হাউস অব কমন্সের সদস্য হয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিমন্ডলে বাঙালির জয়যাত্রার নতুনসারথী। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার টিউলিপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশের ভাবমূর্তি আরোও উজ্জ্বল করবেন এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও ছাত্রলীগ নেতা।
খবর বিভাগঃ
মতামত
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়