হাবিবুল্লাহ ফাহাদ:
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জামায়াত তোষণের অভিযোগ ওঠেছে। বান্দরবান সদর থানায় জামায়াত-শিবিরের হামলার পরও মামলার অনুমতি দিতে ওই কর্মকর্তা গড়িমসি করেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। পরে চাপের মুখে মামলা নিলেও আসামি করা হয় অজ্ঞাতদের, যদিও হামলাকারীদের ছবি এবং পরিচয় সবই আছে পুলিশের কাছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় তার অধঃস্তন এক কর্মকর্তাকে তদবির করে বদলি করার ঘটনাও ঘটেছে। পুরো অভিযোগের তীর বান্দরবানের পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। অভিযোগটি এতটাই গুরুতর যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন তদন্তে নেমেছে তার বিরুদ্ধে।
ঘটনাটি ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বরের। পার্বত্য এলাকা বান্দরবানে ট্রাফিক মোড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন দুই মোটরসাইকেল আরোহী। ওই ঘটনায় জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে সে সময়ের সহকারী পুলিশ সুপারের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়ে রাঙামাটির পিএসটিএসে বদলি করা হয় ওই এএসপিকে। একই সঙ্গে ‘এসপির নির্দেশ মানা হয়নি’ এমন অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জবাব দিয়েছেন এএসপি মোহাম্মদ শিবলী কায়সার। যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন ২০১৩ সালের ওই ঘটনার পেছনের অনেক তথ্য, যা রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন মহলে।
অভিযোগের জবাবে ঘুরেফিরেই পার্বত্যাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ঘটনার পেছনে ‘ষড়যন্ত্রের’ আভাস দেওয়া হয়েছে। মোটরসাইকেল তল্লাশির নামে চালক ও আরোহীকে গুলি করার ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন শিবলী কায়সার। মূলত জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে পার্বত্যাঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্যই ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এই দাবির প্রেক্ষিতে বেশকিছু প্রামাণ্য দলিলও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এসপি দেবদাস ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, ওই ঘটনার পর বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির বিশেষ সভা হয়। যেখানে এসপি সাধারণ মানুষকে পুলিশের গুলি করার ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ ও ‘ইচ্ছে করে করেনি’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চালক সংকেত অমান্য করে মোটরসাইকেল না থামিয়ে পুলিশ সদস্যের গায়ের ওপর তুলে দেন। এ সময় পুলিশ সদস্যের হাতে থাকা গুলি বের হয়ে যায়।
কিন্তু শিবলী কায়সার তার জবাবে লেখেন, এসপি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তাই তিনি কীভাবে বললেন গুলি ভুলবশত হয়েছে? শুরু থেকেই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের রক্ষা করা ও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এসপি ওই বক্তব্য দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।
বান্দরবান পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা যায়, যে মোটরসাইকেল আরোহীদের গুলি করা হয়েছিল তার মধ্যে একজন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওই ঘটনার পরপরই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা বান্দরবান শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। তাদের নেতৃত্বেই হামলা হয় থানায়। এএসপি শিবলীর ওপর হামলাকারীরাও এই দলের লোকজনই ছিলেন।
নিজের ওপর হামলা ও থানা ভাংচুর চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে এসপির সঙ্গে কথা বলেন শিবলী। কিন্তু এসপি বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে এমন শঙ্কা থেকে তাকে মামলা থেকে দূরে থাকতে বলেন। এক পর্যায়ে এএসপির তোড়জোড়ে মামলা করার অনুমতি দেন তিনি। তবে এরপরও জটিলতা দূর হয়নি, বরং বেড়ে যায় ।
শিবলী কায়সার তার জবাবে বলেন, পুলিশ সুপার কার্যালয়ের গেটে এবং ট্রাফিক মোড় ও আশপাশের এলাকায় রক্ষিত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় হামলাকারীদের ছবি ওঠেছে, যা দেখে সহজেই আসামিদের শনাক্ত করা গেছে। এরা হচ্ছেন সাবেক শিবির কর্মী সম্রাট, জাহেদ, রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ডের বাসিন্দা ফয়সাল, আর্মি পাড়ার হানিফ, রুবেল বড়–য়া এবং শাকিল। অথচ এসপির নির্দেশে মামলা করা হয়েছে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামিদের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে দেবদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিবলী কায়সারের বেশ বাদানুবাদও হয়েছে। এমনকি মামলার তদন্ত কাজে ‘গাফিলতির’ অভিযোগও আছে।
ভিডিও চিত্র থাকার পরও তা মামলার তদন্ত কাজে ব্যবহার করা হয়নি। ওই ঘটনায় অন্যতম ভুক্তভোগী শিবলী কায়সারের কোনো সাক্ষ্যও নেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নাছির উদ্দিন। তার ব্যাপারে এসপির কাছে অভিযোগ করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং নানা কৌশলে মামলা দুর্বল করার চেষ্টাও হয়েছেÑএমন তথ্যও তুলে ধরেন বান্দরবানের তৎকালীন সার্কেল এএসপি শিবলী কায়সার।
দায়সারা তদন্ত!
সাধারণ মানুষকে গুলির ঘটনায় জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটিও ‘দায়সারা’ প্রতিবেদন দিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে। কিন্তু ওই ঘটনায় জামায়াত-শিবির কর্মীদের হামলার শিকার শিবলী কায়সার ও তার আহত দেহরক্ষী কারোই জবানবন্দি নেওয়া হয়নি। একইভাবে পুলিশ সুপারের তদন্ত কমিটিও তদন্ত শেষে ওই ঘটনাটি আসলে দুর্ঘটনা ছিল কি না, ঘটনাস্থলের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহতাব উদ্দিনের দায়-দায়িত্ব কী ছিল, উত্তেজিত জনতা কার নেতৃত্বে থানায় হামলা চালাল-এসব বিষয়ে কোনো তথ্যই তুলে ধরা হয়নি। বরং পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র বহনে সতর্কতা, চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার বিষয়ে সজাগ করা এবং পুলিশ কর্মকর্তারা তার অধীনস্থদের দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে ‘ব্রিফ’ করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
সাধারণত রাস্তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতা নিতে হয়। কিন্তু ১১ নভেম্বরের ওই ঘটনার সময় পুলিশ কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন সশস্ত্র পুলিশকে ট্রাফিকের কাজে ব্যবহার করেছেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে শিবলী কায়সার বলেন, ট্রাফিক আইনের কোনো ধারায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কোনো বিধান না থাকলেও কেন ট্রাফিকিংয়ের কাজে আগ্নেয়াস্ত্রসহ পুলিশ ব্যবহার করা হলো? ওই ঘটনার পেছনে মাহতাব উদ্দিনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মাহতাব উদ্দিন এবং পুলিশ সদস্য প্রণয় চাকমাকে কোনো ধরনের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। বরং সব ধরনের অভিযোগের ঊর্ধ্বেই আছেন তারা।
আসামি গ্রেপ্তারে বাধা
পুলিশের ওপর ও হামলার ঘটনায় করা মামলায় আসামি গ্রেপ্তারেও বাধা দেওয়া হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিখিত জানিয়েছেন এএসপি শিবলী কায়সার। তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামি গ্রেপ্তার করতে চাওয়া কোনো অপরাধ নয়। তাছাড়া সার্কেল এএসপি আসামি চেনার পরও তাকে গ্রেপ্তারে বাধা দেওয়া পুলিশ আইনে নেই। অথচ পুলিশ সুপার নানা কৌশলে আসামি গ্রেপ্তার না করতে চাপ সৃষ্টি করেন।’
পুলিশের ঊর্ধ্বতন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবান জেলায় যোগ দেওয়ার আগে দেবদাস ভট্টাচার্য দিনাজপুর জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন। তিনি সেখানে থাকতে চিরিরবন্দরে সাঈদীকে চাঁদে দেখার ঘটনার পর জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীরা ব্যাপক তা-ব চালায়। ওই ঘটনায় এসপিকে দিনাজপুর থেকে তুলে নিয়ে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। অভিযোগ ওঠে, জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উপঢৌকন হাতিয়ে নিয়ে এভাবে তা-ব চালানোর সুযোগ করে দেন তিনি। অভিযোগ জোরালো হলে ওই এলাকার সংসদ সদস্য ও সরকারি দলীয় হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে দিনাজপুর থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবে বান্দরবান নিয়েও কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকতে পারে বলে অভিযোগ রয়েছে।
যে অভিযোগ এএসপির বিরুদ্ধে
সূত্রে জানা যায়, আদেশ অমান্য করে আসামি গ্রেপ্তারের অভিযোগ এনে গত বছরের ৫ মে এএসপি শিবলী কায়সারের কাছে কৈফিয়ত চান এসপি দেবদাস ভট্টাচার্য। যেখানে বলা হয়, মোটরসাইকেল আরোহীদের গুলির ঘটনায় পরিস্থিতি বেসামাল হলে এএসপি শিবলীকে তিনি ঘটনাস্থলে পাঠান। কিন্তু এএসপি সেখানে গিয়ে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার পরিবর্তে পিস্তল তাক করলে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু গত বছরের ৭ মে পুলিশ সদর দপ্তরে দেওয়া চিঠিতে তিনি এই অভিযোগ তুলে ধরেননি। বরং সেখানে বলা হয়, পুলিশ ও থানায় হামলা মামলায় জনৈক আসামিকে নিজ কার্যালয়ে ধরে এনে নির্যাতন চালান শিবলী কায়সার। পরে তিনি দুই অভিযোগ থেকে সরে এসে লিখেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ঘটনায় কাউকে আপাতত হয়রানি না করার কথা বললেও এএসপি হানিফ নামে এক ব্যক্তিকে ধরে কোর্টে চালান দেওয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন রাসেলকে বলেন।
তবে শিবলী কায়সারের দাবি, তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ পুরোটাই ‘বানোয়াট’। তিনি বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনা ছিল একটি চক্রান্তের অংশ। আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সব জেনে ফেলায় জামায়াত-শিবিরের লোকজন আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। যে পুলিশ সদস্য গুলি করল, যার নেতৃত্বে অভিযান চলল সেই পুলিশ কর্মকর্তাদের গায়ে একটা ফুলের টোকাও কেউ দেওয়ার সাহস করল না, অথচ আমার ওপরে হামলা হলো কেন? এই প্রশ্নের জবাব চাইতে গিয়েই আমি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি।’
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিষয়টি তো দেড় বছর আগের। এখন কেন এনিয়ে কথা হচ্ছে? আমি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’
সেদিন যা ঘটেছিল
২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর পার্বত্য এলাকা বান্দরবানের ট্রাফিক মোড়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে চলছিল মোবাইল কোর্ট। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে তল্লাশির সময় পুলিশ সদস্য প্রণয় চাকমা শর্টগানের গুলি ছুঁড়লে আরোহী ব্যবসায়ী আজাদ হোসেন ও তার সঙ্গে থাকা আরেক ব্যক্তি আহত হয়। পরে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুহূর্তেই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। হামলা হয় থানায়। পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষে সহকারী পুলিশ সুপারসহ ১৪ জন আহত হন। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।
খবর বিভাগঃ
সারাদেশ

0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়