Friday, March 27

লাঙ্গলবন্দ ট্রাজেডির কারণ খুঁজতে তদন্ত কমিটি


নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে মহাঅষ্টমী পুণ্যস্নানে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে সাত নারীসহ ১০ জন পুণ্যার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় এর কারণ উদঘাটন করতে একটি তদন্ত কমিটি করেছে প্রশাসন। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুর রহমান হাবিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান। তাদের ৫ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে মহাষ্টমী স্নান উৎসবের লগ্ন শুরু হওয়ার পর থেকে পুণ্যার্থীদের ঢল নামে লাঙ্গলবন্দে। স্নানে অংশ নিতে এবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক পুণ্যার্থী আসে লাঙ্গলবন্দে। পুণ্যার্থীদের জন্য ১৬টি ঘাটে স্নানের আয়োজন করে স্নান উদযাপন কমিটি। ১৬টি স্নান ঘাটের মধ্যে অন্যতম প্রধান রাজঘাটে স্নান করলে পুণ্য বেশি হয়-এই মতাদর্শে কারণে পুণ্যার্থীদের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা এবং এর মধ্যে লোহার বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়ার গুজবে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুণ্যার্থীরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে পদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই সাতজন নারী ও তিন পুরুষসহ ১০ পুণ্যার্থী নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো ২০ পুণ্যার্থী। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, রাজঘাট ছিল লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের কোনো জায়গা ছিল না। এমনিতেই রাস্তা খুবই সংকীর্ণ। এই প্রচণ্ড জনচাপে শৃঙ্খলা রক্ষার কোনো আয়োজনও ছিল না। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ২০-২৫ জনের একটি দল ঢোল-বাদ্য সহকারে দ্রুতগতিতে রাজঘাটের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। এ সময় হৈ হুল্লোড়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। জনচাপে পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই সাতজন নারী ও তিন পুরুষসহ ১০ পুণ্যাথী নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো ২০ পুণ্যার্থী। তাদের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুণ্যার্থীরা আরো অভিযোগ করেন, লাঙ্গলবন্দে প্রতিবছর মহাতীর্থ স্নান উৎসব হলেও ব্রহ্মপুত্র নদের কচুরীপানা পরিষ্কার করা হয়নি। গোসলের ঘাটগুলোতে কচুরীপানা ও কাদা পানি ছিল। নদটি যথাযথভাবে খনন না করায় গভীরতা কমে যাওয়ায় এই কাঁদাপানির সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মহিলাদের কাপড় বদলানোরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জরুরি ভিত্তিতে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও। অন্যদিকে স্নানকে কেন্দ্র করে গাড়ি ভাড়া পুণ্যার্থীদের কাছ থেকে দুই থেকে তিন গুণ বেশি নেয়া হয়েছে বলেও তাদের অভিযোগ। এই ঘটনায় নিহতরা হলেন মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামের বলাই দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৭০), তার ছেলে নিত্য গোপাল দাস, ঢাকার ঝিগাতলা নিবাসী নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতী দাস (৬০), তার মেয়ে ঢাকার লালবাগের শেখ সাহেব বাজার এলাকার জনি চন্দ্র দাসের স্ত্রী রাহী দাস (২৫), মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার চর মুগিরা গ্রামের নন্দগিরি সাহার ছেলে স্থানীয় চরমুগিয়া সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক নকুল সাহা (৫০), কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির পরিমল সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫২), নোয়াখালী জেলার কবিরহাটের অনীল নাথের স্ত্রী ভানুমতি নাথ (৫০), কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকার কালিপদ নন্দির ছেলে রণজিৎ নন্দি (৫৫) ও কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের পরিমল দেবনাথের স্ত্রী তুলসী দেবনাথ (৫৫) এবং পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার লোহালিয়া গ্রামের দ্বিজেন্দ্র লাল সেনের স্ত্রী সুচিত্রা সেন (৫০)। লাঙ্গলবন্দ স্নানোৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাসু দেব চক্রবর্তী জানান, কালর্ভাটের সামনে পুণ্যার্থীদের ঢল নামার কারণে ঘটেছে এই দুর্ঘটনা। এখানে দায়িত্বে অবহেলার কোনো অভিযোগ সত্য নয়। রাস্তা ও লোহার কালভার্টটি সরু এবং সড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা ও লোহার কালর্ভাটটি প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন। বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোকাররম হোসেন জানান, স্নান শুরু হওয়ার পর থেকে ভিড়ের চাপে রাজঘাটে ওই দুর্ঘটনায় ১০ জন মারা গেছে। আগে থেকে সহস্রাধিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে এই ঘটনার পরে প্রত্যেকটি ঘাটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাস্তার মাঝখানে পুলিশ সদস্যরা নিজেরা মানব ঢাল তৈরি করে আসা যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, এই দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমানের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। পুণ্যার্থীরা যাতে সুশৃঙ্খল পরিবেশে স্নান সম্পন্ন করতে পারেন সেজন্য প্রশাসন ও পুলিশকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা জানান, সব রকম প্রস্তুতি নেয়ার পরেও সরকারি ছুটির দিনের সাথে পুণ্য তিথি যোগ হওয়ায় পুণ্যার্থীদের ঢল বেশি নামায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহতদের লাশ অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ইশরাত হোসেন খানের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুর রহমান হাবিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান। তাদের ৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্নান উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাসু দেব চক্রবর্তী জানিয়েছেন স্নানের লগ্ন শেষ হবে শনিবার ভোর ৬টা ৫৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়