তাকদির আরবি শব্দ। আরবি কদর বা তাকদির শব্দের অনেকগুলো অর্থ রয়েছে, যেমন_ অদৃষ্ট, ভাগ্য, নিয়তি, ফলাফল, পরিণতি, কোনো কিছু পরিচালিত বা সংঘটিত হওয়ার বিধিবিধান, আইনকানুন, নিয়মনীতি বা পদ্ধতি। মানুষের কৃত সব কাজের ভালো বা মন্দ ফলাফল, জীবন-মৃত্যু, বেহেশত বা দোজখ প্রাপ্তি এবং মহাবিশ্বের অন্যসব সৃষ্টির মধ্যে সংঘটিত হওয়া যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার ব্যাপারে মহান আল্লাহ সৃষ্টির শুরুতে পৃথক পৃথক বিধিবিধান তৈরি করে রেখেছেন, যা মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টির পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেছেন, তুমি বলে দাও! আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে (লিখে) দিয়েছেন তাছাড়া অন্য কোনো বিপদ আমাদের ওপর আসতে পারে না, তিনিই কর্মবিধায়ক আর সব মোমিনের কর্তব্য হলো_ তারা যেন নিজেদের যাবতীয় কাজে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে। (সূরা তওবা : ৫১)। আল্লাহর এ নির্ধারণই হলো তাকদির বা ভাগ্যলিপি। একজন মুসলমানকে যে সাতটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি ঈমান বা দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো তাকদিরের ওপর বিশ্বাস। তাকদিরের বিশ্বাসের চারটা মৌলিক দিক রয়েছে_
* আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, যা কিছু জমিনে প্রবেশ করে, যা কিছু তা থেকে বের হয়, যা কিছু আকাশ থেকে নামে এবং যা কিছু তাতে উত্থিত হয় প্রত্যেকটি জিনিস তিনি জানেন। তিনি দয়াবান ও ক্ষমাশীল। (সূরা সাবা : ২)।
* যা যা হবে তার সবকিছুই আল্লাহ তায়ালা কিতাবে (লাওহে মাহফুজ) লিখে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানেন না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকার প্রদেশে এমন একটি শস্যকণাও নেই, যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন। শুষ্ক ও আর্দ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে।' (সূরা আনআম : ৫৯)।
* যা কিছু হবে, তা আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করেছেন বলেই হবে। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে কোনো কিছু হবে, ইচ্ছা না করলে কিছুই হবে না। যেমন_ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, আর তোমরা চাইলেই কিছু হয় না, যতক্ষণ না আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তা চান। (সূরা তাকবির : ২৯)।
* যা কিছু সৃষ্টি হবে তার সব কিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। যেমন_ এরশাদ হচ্ছে, 'আর আল্লাহই তোমাদেরও সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যে জিনিসগুলো তৈরি করো তাদেরও।' (সূরা সাফফাত : ৯৬)।
তাকদির সম্পর্কে রাসূল (সা.) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জিবরাঈল (আ.) মানুষরূপ ধারণ করে রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলে দিন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ঈমানের অর্থ হলো এই, তুমি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর পয়গম্বর ও পরকালের ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে। আর তাকদিরের (লিখিত) ভালো-মন্দের ওপরও দৃঢ়বিশ্বাস আনবে।' (মুসলিম শরিফ)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, সত্যবাদী ও সত্যের বাহক রাসূল (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান মাতৃগর্ভে ৪০ দিন পর্যন্ত জমাট বাঁধতে থাকে। তারপর তা অনুরূপভাবে জমাটবদ্ধ হয়ে রক্তপি-ে রূপ নেয়। পুনরায় রক্তপি- তদ্রূপ ৪০ দিনে মাংসের টুকরায় পরিণত হয়। অতঃপর আল্লাহ চারটি কথার নির্দেশসহ তার কাছে একজন ফেরেশতা পাঠান। সে তার আমল, মৃত্যু, রিজিক এবং পাপিষ্ঠ হবে নাকি নেককার হবে_ এসব লিখে দেয়। এরপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেয়া হয়। জন্মের পর এক ব্যক্তি একজন জাহান্নামির ন্যায় ক্রিয়াকর্ম করতে থাকে। এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে মাত্র এক হাতের ব্যবধান থাকে, এমনি সময় তার তাকদির (নিয়তির লিখন) এগিয়ে আসে। তখন সে জান্নাতবাসীদের অনুরূপ আমল করে যায়, ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। আর এক ব্যক্তি জান্নাতবাসীর মতো আমল করতে থাকে, এমনি সময় তার তাকদির (নিয়তির লিখন) এগিয়ে আসে, তখন সে জাহান্নামবাসীর মতো আমল করতে থাকে, ফলে সে জাহান্নামি হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করে। (সহিহ বোখারি)।
তাকদির অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে হাদিস শরিফে হুশিয়ার বাণী উল্লেখ করা হয়েছে। 'ঈমান হচ্ছে, তুমি আল্লাহ তায়ালা, তাঁর সব ফেরেশতা, তাঁর যাবতীয় (আসমানি) কিতাব, তাঁর সব রাসূল এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে তাকদির এবং এর ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে। (মুসলিম শরিফ : ৮)। তাকদির বা অদৃষ্ট সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জিবরাঈল (আ.) আমাকে বলল, মহান ও মর্যাদাশীল আল্লাহ বলেছেন, 'হে মুহাম্মদ! যে লোক আমার ওপর ঈমান এনেছে অথচ আমার দ্বারা ভালো-মন্দ নিয়ন্ত্রণে (অদৃষ্টে) বিশ্বাস রাখে না, সে যেন আমাকে ছাড়া আরেকজন প্রতিপালক খুঁজে নেয়।
অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন, যদি তাকদির অনুসারেই সব কিছু হয়ে থাকে তাহলে আমরা গোনাহ করলে এ জন্য আমাদের দোষ কি? আসলে এ ধরনের প্রশ্ন করা কাফের মোশরিকদের স্বভাব ছিল। তারা তাদের নাফরমানির জন্য তাকদিরকে দায়ী করত। কোরআনে তাদের কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে_ এ মোশরেকরা (তোমাদের এসব কথার জবাবে) নিশ্চয়ই বলবে, যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে আমরা শিরকও করতাম না, আমাদের বাপ-দাদারাও শিরক করত না। আর আমরা কোনো জিনিসকে হারামও গণ্য করতাম না। এ ধরনের উদ্ভট কথা তৈরি করে তাদের পূর্ববর্তী লোকেরাও সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, এভাবে তারা অবশেষে আমার আজাবের স্বাদ গ্রহণ করেছে। (সূরা আনআম : ১৪৮)।
মূলত তাকদিরে লেখা আছে বলে আমরা কোনো কাজ করতে বাধ্য নই বরং আমরা আল্লাহ প্রদত্ত ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কোনো কাজ করব বলেই আল্লাহ লিখে রেখেছেন। যেহেতু বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অতীত সব আল্লাহর কাছে সমান, তাই আল্লাহ তায়ালা বান্দা তার ইচ্ছা শক্তি দ্বারা কী কাজ করবে তা অগ্রিম অবগত হয়ে তাকদিরে লিখে রেখেছেন। বান্দা অচেতন পদার্থের মতো নয় যে, তার নিজের কোনো ইচ্ছা কার্যকর হবে না, বরং তাকে এখতিয়ার বা ভালো-মন্দ গ্রহণের শক্তি দেয়া হয়েছে। আর এ জন্যই খারাপ গ্রহণ করার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হবে।
তাকদিরের ব্যাপারটি যদি সহজে বুঝে না আসে তাহলে এ ব্যাপারে নীরব থাকাই মোমিনের কাজ। কারণ, এ ব্যাপারে অধিক ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে অনেকের পদস্খলন ঘটেছে, অনেকে ঈমানহারা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়েই ইসলামে অনেক বাতিল ফেরকারও উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, আমরা যেন অহেতুক প্রশ্ন করে তাদের দলভুক্ত না হই।
হাদীস শরিফের শিক্ষা হল, প্রত্যেকের উচিত সৎ কর্ম করতে থাকা। কারণ প্রত্যেকের তাকদিরে যা লেখা আছে, সেটিই তার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
লেখক : মোহাদ্দেস, ছারছীনা দারুসসুন্নাত
কামিল মাদরাসা
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়