Saturday, August 10

ঈদুল আজহা ও কোরবানি

 মাওলানা দৌলত আলী খান::
কোরবানি আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলোর মধ্যে একটি ফরজ বিধান। এটি হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত। তার ত্যাগের বিনিময়ে মুসলিম উম্মাহ এ সুন্নতটি পেয়েছে। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে পশু জবাই করে কোরবানি আদায় করা হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ ও কোরবানি আদায় করুন।’ (সূরা কাউসার : ২)।
কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) এর হাদিস রয়েছে। হজরত জাইদ বিন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা সাহাবারা রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কোরবানি কী? উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত।’ তারা ফের প্রশ্ন করলেন, এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান আছে? প্রত্যুত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একেকটি সওয়াব পাবে।’ ফের সাহাবারা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! উট বা দুম্বার পশমের কী হুকুম? তদুত্তরে নবীজি (সা.) বললেন, ‘এসবেরও প্রতিটি পশমের পরিবর্তে নেকি পাবে।’ (ইবনে মাজাহ : ৩২৪৭)।
রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কোরবানির দিন কোরবানির রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় অন্য কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। ওই ব্যক্তি কেয়ামতের দিন জবাইকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পবিত্র মনে কোরবানি আদায় করো।’ (ইবনে মাজাহ : ৩১২৬)।
তাকবিরে তাশরিকের আমল : জিলহজ মাসের ৯ তারিখের সকাল থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পুরুষরা উচ্চৈঃস্বরে এবং মেয়েরা মৃদুস্বরে নিম্নোক্ত তাকবির একবার বলা ওয়াজিব। চাই নামাজ জামাতে পড়া হোক কিংবা একাকী পড়া হোক। তাকবির হলো এইÑ ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ কিন্তু কিছু কিছু মুসল্লিকে উল্লেখিত তাকবিরটি তিনবার পড়তে দেখা যায়। মূলত হাদিসে একবার পড়ার কথা রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হওয়া কর্তব্য। (ফাতাওয়া শামি : ২/১৭৮)।
খুতবা দানকালে মুক্তাদির জন্য তাকবিরে তাশরিক বলা নিষেধ : ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময় ইমাম খুতবা দানকালে মুসল্লিদের তাকবিরে তাশরিক পড়তে দেখা যায়। এমনকি অনেকে খুতবার সময় ইমামের মুখে মুখে তাকবিরে তাশরিক বলাকে বেশি ফজিলতময় হিসেবে জানে। এ আমলটি ইসলামি শরিয়তবিরোধী। কারণ খুতবা চলাকালীন মুক্তাদির জন্য নামাজ, দোয়া বা তাকবিরে তাশরিক আস্তে বা উচ্চৈঃস্বরে কোনোভাবেই পড়া জায়েজ নেই। বরং মুক্তাদির জন্য চুপচাপ বসে মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনা ওয়াজিব। তাই দুই ঈদের নামাজের খুতবার সময় ইমামের সঙ্গে তাকবিরে তাশরিক পড়া থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখতে হবে। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/১৮০; আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/১১৩)।
ঈদুল আজহার সুন্নত : ঈদুল আজহার দিন বিশেষভাবে নিম্নোক্ত সুন্নতগুলো পালনীয়Ñ ১. পবিত্র ও উত্তম পোশাক পরিধান করা। ২. শরিয়তসম্মত সুসজ্জিত হওয়া। ৩. গোসল করা। ৪. মেসওয়াক করা। ৫. সুগন্ধি ব্যবহার করা। ৬. খুব ভোরে জাগা। ৭. ঈদের নামাজের আগে কিছু না খাওয়া, বরং নিজের কোরবানির গোশত থেকে প্রথমে খাওয়া। ৮. ঈদগাহে যাওয়ার সময় উচ্চৈঃস্বরে তাকবিরে তাশরিক বলা। ৯. ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়া। ১০. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া, অন্য পথে ফিরে আসা। ১১. ঈদের নামাজের আগে ঘরে বা ঈদগাহে নফল নামাজ না পড়া এবং ঈদের নামাজের পর ঈদগাহে নফল নামাজ না পড়া। (ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/১৪৯)।
গোশত বণ্টন : কোরবানির গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজের জন্য রাখা, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া এবং এক ভাগ গরিব-মিসকিনকে দান করা মুস্তাহাব। তবে কোনো কারণে এর ব্যতিক্রম করা জায়েজ আছে। (আদদুররুল মুখতার : ৬/৩২৮)।
চামড়ার হুকুম : কোরবানির চামড়া নিজের কোনো কাজে ব্যবহার করা জায়েজ আছে। অথবা কাউকে হাদিয়া দেওয়া যায়। কিন্তু বিক্রি করলে তার মূল্য সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। (হেদায়া : ৪/৪৫০)।
কোরবানির চামড়া দ্বারা পারিশ্রমিক দেওয়া যাবে না। তেমনি যারা গোশত তৈরি করে, তাদের বেতন হিসেবে চামড়া বা গোশত দেওয়া যাবে না। বেতন দেওয়ার পর তাদের আলাদাভাবে চামড়া বা গোশত দেওয়া ভিন্ন কথা। (হেদায়া : ১/২৩২)।
কোরবানির পশু : সাধারণত ভেড়া, দুম্বা, ছাগল, গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা হয়। কোরবানির পশু সুন্দর, সুঠাম ও নিখুঁত হওয়া চাই। এক-তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে বেশি কান বা লেজ কাটা, খোঁড়া, চলতে অক্ষম, রোগা, মূল থেকে শিং ভাঙা প্রভৃতি ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ নয়। এছাড়াও কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইসলামি শরিয়ত পশুর বয়স নির্ধারিত করে দিয়েছে। যেমনÑ উট-উটনির বয়স পূর্ণ পাঁচ বছর, গরু-মহিষের বয়স দুই বছর এবং দুম্বা, ভেড়া ও ছাগলের বয়স এক বছর পূর্ণ হতে হবে। তবে ছয় মাসের দুম্বা-ভেড়া মোটাতাজার দিক থেকে যদি এক বছরের দুম্বা-ভেড়ার মতো মনে হয়, তখন তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ।
আর কিছু কিছু এলাকায় পশু জবাই করার পর মোনাজাত করতে দেখা যায়। এটি ভিত্তিহীন। ইসলামি শরিয়তে এর কোনো বিধান নেই। তাই পশু জবাই করার পর মোনাজাত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। (ফাতাওয়া শামি : ৬/৩২২-৩২৫)।
যৌথ কোরবানি : গরু, মহিষ ও উটÑ এই তিন প্রকার পশুর মধ্যে যৌথভাবে কোরবানি করা জায়েজ। তবে এক পশুর মধ্যে সাতজনের বেশি শরিক হতে পারবে না। যৌথ কোরবানির ক্ষেত্রে সবার নিয়ত পরিশুদ্ধ হতে হবে। কারও নিছক গোশত খাওয়ার নিয়ত থাকলে কোরবানি হবে না। এক্ষেত্রে একজনের নিয়তে ত্রুটি থাকলে সবার কোরবানি হবে না। যৌথ কোরবানিতে গোশত পাল্লা দিয়ে মেপে সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে, যাতে কারও অংশে কম-বেশি না হয়। (ফাতাওয়া শামি : ৬/৩২৬; হেদায়া : ৪/৪২৮)।
কোরবানির পশু দ্বারা আকিকা পালন : কোরবানির গরু, মহিষ ও উটের সঙ্গে আকিকা করা জায়েজ। তবে এক্ষেত্রে ছেলে হলে দুই অংশ এবং মেয়ে হলে এক অংশ দেওয়া ভালো। কিন্তু ছেলের জন্য এক অংশ নিলেও আকিকা আদায় হয়ে যাবে। আর ছাগল দ্বারা আকিকা করলে তখন ছেলে হলে দুটি ছাগল এবং মেয়ের ক্ষেত্রে একটি ছাগল জবাই করা সুন্নত। তবে ছেলের ক্ষেত্রে একটি ছাগল দিলেও আকিকা পালন জায়েজ হবে। এ আকিকা শিশু জন্ম গ্রহণের সপ্তম দিনে করা উচিত। সপ্তম দিনে করতে না পারলে জীবনের যে কোনো সময় আকিকা আদায় করা যায়। আর গোশতগুলো কাঁচা বণ্টন করুক কিংবা রান্না করে খাওয়ানো উভয়টি জায়েজ আছে। আকিকার গোশত আকিকা পালনকারী নিজেও খেতে পারবে। আত্মীয়স্বজন ও গরিব-মিসকিনদেরও খাওয়াতে পারবে। এই মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা পাখিকে তাদের বাসায় অবস্থান করতে দাও।’ উম্মে কুরজ বলেন, ‘আমি তাকে এটা বলতে শুনেছি যে, ছেলের পক্ষ থেকে দুটি বকরি এবং মেয়ের পক্ষ থেকে একটি বকরি দিতে হয় এবং সেগুলো ছাগ বা ছাগি হওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই।’ (মেশকাত : ৩৯৭৩; ফাতাওয়া রহিমিয়া : ২/৯৪)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়