Saturday, December 23

কানাইঘাটের এক মুক্তিযোদ্ধার আকুতি!


জসিম উদ্দিন : আহমদ আলী। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার ৮নং ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়নের (গাছবাড়ী) ফখরচটি গ্রামে তাঁর জন্ম। মৃত মোছন আলীর ছেলে। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সবার মত দেশের টানে, মায়ের মান বাঁচাতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বীরত্বের সাথে তিনি যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে ৭ ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে তিনি আর ঘরে বসতে থাকতে পারেন নি, বের হয়ে পড়েন স্বাধীনতার জন্য। পাকিন্তানি পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। কাদে তুলে নেন লাটি। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ভারতে গিয়ে। তারপর পাক সেনাদের বিরুদ্ধে শুরু করেন এ্যাকশন। খতম করেন অনেক পাক বাহিনীদের। নিজেও পাকসেনাদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন। এভাবেই মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা বর্ণনা করেন বীর এই মুক্তিযুদ্ধা। যৌবনের এক সাহসী যুবক আহমদ আলী আজ বৃদ্ধ বয়সে আকাশে মেঘ দেখলেই ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠেন। ১৯৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার যুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাস সম্মুখ যুদ্ধ করে অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই দেশকে স্বাধীন করেতে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। মনে মনে ভাবতেন আমরা আর পরাধীন থাকব না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীরের মত চলব। কিন্তু অভাবের তাড়নায় আজ বৃদ্ধ বয়সে সে সবই তাঁর কাছে শুধুই স্মৃতি। বাবার রেখে যাওয়া ৯শতক জায়গায় কোন রকম দুটি ছোট ঘরে বাস করেন। বাড়ীতে ঘরের জমিটুকু ছাড়া সহায় সম্বল বলতে আর কিছুই নেই। সরকারের দেয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ১০ হাজার টাকাই আয়ের একমাত্র উৎস। আজ নড়বড়ে টিনের ঘরে মেঘলা আকাশ দেখে আতংকিত হয়ে উঠেন সেই বীরমুক্তিযোদ্ধা আহমদ আলী। বয়সের ভারে যৌবনের সেই সাহস আজ আর নেই। টিন দিয়ে তৈরী লাকড়ীর ঘরটিতে বসতঘর হিসাবে ঠাঁই মিলেছে বীরমুক্তিযোদ্ধা আহমদ আলীর। বাঁশ-বেতের তৈরী বেড়া উঁই পোকা খেয়ে ফেলেছে।কালবৈশাখী ঝড়ে বৃষ্টিতে ভেজা বিছানায় রাত্রি কাটান তিনি। ঝড়, তুফান, কালবৈশাখীতে তিনি ভয়ে এখন আতংকিত হয়ে উঠেন, কখন জানি উড়িয়ে নিয়ে যায়। এ প্রতিনিধিকে তিনি আরও জানান, বীরমুক্তিযোদ্ধা শব্দটি ছেলে-মেয়েদের নিকট এখন অর্থহীন একটি শব্দ। আমি ওদের কি দিতে পেরেছি? হয়ত আর ক’দিন পরেই মরে যাব, লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বিউগল বাজিয়ে আমার দাফন কার্য শেষ হবে। এতে আমার সন্তানদের কি লাভ? যাদের দু’বেলা ভাত দিতে পারিনি। আমি মুক্তিযোদ্ধা বাবা হিসাবে ওরা কেন গর্ববোধ করবে? দাম্পত্য জীবনে ২ ছেলে আর ১ মেয়ের জনক।মেয়েকে বিয়ে দিতে অনেক অর্থ ঋণ করেছেন,বর্তমানে সে ও স্বামীর বাড়ী ছেড়ে বাবার বাড়ীতে থাকে। এসব কথা বলতেই দু’চোখের জল চলে আসে বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ আলীর। । ১৯৭১ সালে ২০ বছরের টগবগে যুবক এই সেই আহমদ আলী ঝাপিয়ে পড়লেন পাকা হানাদার বহিনীর বিরোদ্ধে। তিনি জানান,ভারতের করিমগঞ্জ হয়ে টাউন হলে ৩ দিন থেকে ৪নং সেক্টর কমান্ডার শীর দত্ত বাবুর নেতৃত্বে লোহার বন ক্যাম্পে ২১ দিন উ”চতর ট্রেনিং গ্রহণ করেন। পরে কানাইঘাটের আটগ্রাম,মস্তাজ গঞ্জ,জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত,লাতু এলাকাসহ বেশকিছু এলাকায় পাকহানাদারের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। আহমদ আলীর মুক্তিবার্তার লাল বই নম্বর-০৫০১০৬০২৪৪। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের গেজেট নং-৪১৯৮,তাং ২৬-০৭-২০০৬। আহমদ আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু নিজের শরীরে মরণব্যাদি ক্যান্সার বাঁধায় আজ হেরে গেছি। এক বছর ধরে অসুস্থ্য থেকে সব সঞ্চয় দিয়ে চিকিৎসা চালাই। কিন্তু‘ তার পরও সুস্থ্য হয়ে উঠতে পারিনি।’ দীর্ঘ ৯ মাস খেয়ে না খেয়ে রাত দিন নিদ্রাবিহীন বিরাম হীন কষ্ট করে শত্রুর মোকাবিলা করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম, কারো পরাধীনতায় না থেকে স্বাধীন ভাবে বেচে থাকার জন্য। একটি লাল সবুজের পতাকার স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। অভাবের তাড়নায় পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারিনি। বাবারও কোন সহায় সম্পত্তি ছিলনা। অভাবের তারনায় নিজের ছেলে মেয়েদেরকেও ভাল ভাবে লেখাপড়া করাতে পারিনি। আমি নিজেও অসুস্থ অর্থের অভাবে ভাল কোন চিকিৎসা নিতে পারিনা। নিজের কোন অর্থ সম্পদ না থাকায় সরকারের দেওয়া মাসিক ১০ হাজার ভাতা নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছি। মরার আগে একটি শক্ত ঘরে নির্ভয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন মুক্তিযোদ্ধা আহমদ আলী। মরার আগে যদি সরকার আমার জরার্জীন বসত ঘরটি মেরামত করে দিত তা হলে মরে গিয়েও এ দেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বার্থক হতাম। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নিকট শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করার অাবেদন জানান তিনি।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়