Friday, January 15

নিজের সন্তানের লাশের বুকে ছুরি চালানো ডোম মতি


ইকবাল মাহমুদ মফস্বলের সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংবাদ সূত্রকে নিয়মিত অনুসরণ করতে হয়। যেমন, হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশন, মর্গ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ফায়ার সার্ভিস ইত্যাদি। বেশীরভাগ ঘটনা-দুর্ঘটনা এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছুঁয়ে যায়। তাই খবরের জন্য এসবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়। মুলতঃ চলমান ঘটনার খবরের জন্য যোগাযোগ রাখলেও এগুলো থেকে মাঝে মধ্যে স্পেশাল রিপোর্ট বের করে আনা যায়। এক সময় বাড়ি থেকে অফিসে আসার পথে প্রতিদিন হাসপাতাল এবং মর্গ ঘুরে আসতাম। প্রতিদিন যে খবর পেতাম, তা নয়। অধিকাংশ দিনই শুন্য হাতে ফিরতে হত। কোন কোন দিন মর্গের ডোম মতি মিয়া দূর থেকেই বলে দিতো ‘কিচ্ছু নাই, কিচ্ছু নাই’। একদিন এই ‘কিচ্ছু নাই’ শুনেও ক্ষান্ত হলামনা। গল্প জুড়ে দিলাম মতি মিয়ার সাথে। লাশ কাটতে কাটতে দিলটা পাসান হয়ে গেছে মতি মিয়ার। মানুষের শরীর কাটা এখন তার কাছে ঘাঁস কাটার মত। সারাক্ষন রক্ত নিয়ে নাড়াচাড়া, কাপড়েও লেগে থাকে ছোপ ছোপ রক্ত। মেজাজ ঠিক রাখার জন্য প্রায়ই তরলাসক্ত হতে হয় তাকে। একটা বিকট গন্ধ বেরিয়ে আসছিলো শরীর থেকে। এরপরও তার গল্পের মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা আমি। জীবনের করুণ গল্প বলে যাচ্ছেন মতি। প্রথম প্রথম ভয় পাইতাম, আস্তে আস্তে যত্ন কইরা কাডতাম, পরে দেহি সময় লাগে বেশী, আর এই কাম যত জলদি শেষ করন যায় ততই ভালা। মাঝে মাঝে দু-চারটা লাশ একলগে আইয়া ফড়ে। তহন মেজাজ ঠিক থাহেনা। কচুর লাহান কাডি।” পাক্কা জল্লাদের মত কথাগুলো বলে যাচ্ছিল মতি। আরো নানান কথা বলে, বউ এর কথা, সন্তানদের কথা, ঘুষ খাওয়ার কথা সব অবলিলায় বলে যায়। লাশ কাটার এই কাজে কখনও কি কষ্ঠ লেগেছিলো মনে? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বর নেমে আসে মতির, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। হাত -পা কাঁপতে থাকে, চোখ ছলছল করতে থাকে। আমি ঘাবড়ে যাই। ‘কি হলো মতি ভাই, শরীর খারাপ লাগছে? পানি আনব?’ মাথে নাড়েন মতি। সারাক্ষণ যে মতির চেহারায় বীরত্বের ভাব লেগে থাকে, আজ সেখানে ভয় আর বিষাদের ছাপ। এ চেহারা আমার কাছে বড় অপরিচিত ঠেকে। মিনিট পাঁচেক নিরব থেকে আবার বলতে শুরু করেন মতি। “জীবনে বহু লাশ কাডছি, ব্যাডা মানষের লাশ, বেডি মানষের লাশ, বাচ্ছার লাশ, বড়লোকের লাশ, ছোটলোকের লাশ। কিন্তু নিজের সন্তানের লাশ আমি কাডমু হেইডা কোনদিন ভাবতে ফারিনি। ছিনতাইকারীদের হামলায় মারা যায় আদরের পোলা। বাচ্ছার লাইগ্যা আমি কাইন্দা বেফানা। এর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টের ঘটনার মুখোমুখি হই। মর্গে ডোম একজনই, সে আমি। হের লাইগ্যা আমার কোন ছুডি নাই মাসে ৩০ দিনই ডিউটি। আমার পোলার লাশ কাটার জন্যও বিকল্প কোন ডোম পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে নিজেই ছুরি চালাই সন্তানের লাশের বুকে।” এতোক্ষনে চোখের পানিতে গাল ভিজে গলা গড়িয়ে বুক ভেসে যাচেছ মতি মিয়ার। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না ক্রমেই চিৎকার-আর্তনাদে রুপ নিচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র তার ছেলে মারা গেছে। আমি সান্তনা দেই। চোখের পানি মুছে দেই নিজ হাতে। হাসপাতালের গেটে নিয়ে আসি তাকে, রেস্টুরেন্টে বসে চা খাই একসাথে। অফিসে ফিরে সেদিন আর তেমন কিছু লেখার শক্তি পেলামনা। তাছাড়া, এটি চলমান কোন ইভেন্ট নয় যে, আজই লিখতে হবে। দুদিন সময় নিয়ে আবেগঘন এক রিপোর্ট নামালাম। “সন্তানের লাশের বুকে ছুরি চালানোর যন্ত্রনা বয়ে বেড়াচ্ছেন ডোম মতি।” ছাপা হল দৈনিক আমারদেশ এর পাতায়। রিপোর্টটি পড়ে বহু পাঠককে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। অনেকেই আমাকে ফোন দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। ভাবলাম, দূর থেকে মতির প্রায় নিয়মিত ডায়লগ ‘কিচ্ছু নাই’ ‘কিচ্ছু নাই’ শুনে যদি ফিরে আসতাম তাহলে এতো মর্মস্পর্শী একটি রিপোর্ট পেতামনা।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়