Friday, April 24

ইফতারি প্রথাকে না বলুন

এহসানুল হক জসীম::

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার ঘিলাতৈল গ্রামের নববধূ হেলেনা বেগমের কথা মনে পড়ে কি? গত বছর রমজানের প্রথম দিনের পরের দিন শ্বশুড় বাড়ি থেকে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল হাতে মেহেদির রং না শুকানো এই গৃহবধূর। বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো ইফতারি নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গালমন্দ করায় হেলেনা আত্মহত্যা করেন। 

হেলেনার শ্বাশুড়ী বলেছিলেন, ইফতারিতে আইটেম কম, মান ভাল নয়, ইত্যাদি নানা কথা। বাপের বাড়ি থেকে বহু কষ্টে পাঠানো ইফতারির আইটেম নিয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকজন নানা কথা শুনানোর কারণে অপমান কইতেও পারেনি, সইতেও পারেনি হেলেনা। 

সিলেট অঞ্চলের কু-প্রথা এই ইফতারি শেষ পর্যন্ত মুত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল হেলেনাকে। তাঁর আত্মদানের মধ্য দিয়ে ইফতারি নামক কুপ্রথার ভয়াবহ রূপ নতুন করে প্রকাশিত হয়েছিল।

বাবার বাড়ি থেকে ইফতারি পাঠানো- এটা সিলেট অঞ্চলের একটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক প্রথা। অন্যান্য অঞ্চলেও হয়তো আছে, কিন্তু সিলেট অঞ্চলের এই প্রথাটি বেশ ভয়ানক এবং মারাত্মক। বাপের বাড়ি থেকে সারাটি জীবন ইফতারি পাঠানোর প্রচলন রয়েছে, যতক্ষণ স্বামীর বাড়িতে ওই মহিলার দেহে প্রাণ আছে। 

নববধূর ক্ষেত্রে প্রথাটি তার সকল ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয়। বিয়ের পর প্রথম বছর ইফতারি মেয়ের জামাইর বাড়িতে পাঠাতে হয় অনেক বেশি পরিমাণে। মেয়ের বাবার সাধ্য থাকুক কিংবা না-ই থাকুক; বিয়ের বছরের প্রথম রমজানে বেশ ভালো বাজেট রাখতে হয়। রমজানের প্রথম দিন এক দফা পাঠাতে হয়, ১৫ রমজানের দিকে তথা মাঝামাঝিতে আরেক দফা, শেষ দিকে আরেক দফা কিংবা ঈদের দিন। মেয়ে বিয়ে দিয়ে যে পিতা রিক্ত হয়ে গেলেন, কয়েক দিন কিংবা কয়েক মাস পর সেই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের পিতা কেমন পাঠাবে তার মেয়ের স্বামীর বাড়ি বিশাল ইফতারি; এবং তিনবার।

পিতা-মাতা বহু কষ্টে যে ইফতারি পাঠান, সেটার জন্যও নববধূকে স্বামীর বাড়িতে যে কত কটূ কথা শুনতে হয় আর মানসিক যন্ত্রণা সইতে হয়; ভোক্তভোগীরাই জানে। 'কম হয়ে গেছে', 'অমুকের বাড়ি থেকে কত কিছু পাঠিয়েছে', 'তুমি ফকিরনির মাইয়্যা' ইত্যাদি নানা কথা। রবী ঠাকুরের হৈমন্তি গল্পে পণের জন্য হৈমন্তিকে মানসিক যন্ত্রণা সইতে সইতে একটা পর্যায়ে তাকে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে, এবং অকালে। সিলেট অঞ্চলের নববধুদের এবং বধূদের অনেকেই তাদের শ্বশুর বাড়িতে রমজানের ইফতারি এবং জৈষ্ঠ্য মাসের আম-কাঁঠালের নাইওরীর জন্য কি তার চাইতে কম মানসিক যন্ত্রণা সইতে হয়? শ্বশুর বাড়ির পরিবারের লোকজন তো শুধু কথা শুনায় না; এ ঘর ও ঘর এবং প্রতিবেশিরা নানা কথা কহিয়া যায়; যদি তারা ইফতারী ও আম-কাঁঠালের নাইওরীর ভাগ না পায়।

তিন কারণে ইফতারি প্রথাকে না বলুন। (১) এটা আইন বিরোধী (২০) সামাজিক কুসংস্কার (৩) অনৈসলামিক প্রথা যা হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে।

বাংলাদেশের যৌতুক বিরোধী আইন অনুযায়ী ইফতারি নিষিদ্ধ। যদিও এই বিষয়ে আমরা অনেকে জানিনা, এই নিয়ে কখনো কোন মামলা হয়নি, বিষয়টি ওই ভাবে আলোচনায় আসেনি। আইনের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-- ইফতারি প্রথা যৌতুকের মধ্যে পড়ে যায়। একজন সুনাগরিকের উচিত- আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। সুনাগরিক হতে গেলে বা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে গেলে ইফতারী প্রথাকে না বলতে হবে। 

অন্যদিকে, এটা যে কত বড় সামাজিক কুসংস্কার, সেটা উপরে হেলেনার আলোচনায় ফুটে উঠেছে। এই পয়েন্টে আলোচনা না করে তৃতীয় পয়েন্টে যাই।

এটা অনৈসলামিক প্রথা দুই কারণে। প্রথমত: এই প্রথা হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। ইসলাম অন্যান্য ধর্মের খারাপ দিক অনুসরণ করাকে কড়াকড়ি নিষেধ করেছে। বলতে পারেন, হিন্দু ধর্মে তো রোজা নেই, তাদের ধর্মে তো ইফতারও নেই, তাহলে এই প্রথা তাদের ধর্ম থেকে কিভাবে এলো? বাপের বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়িতে দেওয়ার প্রচলন আমাদের এই উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মে চালু হয়। হিন্দু ধর্মে মেয়ে পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পায় না বলে বিয়ের সময় পণ, পরবর্তী সময় আরো বিভিন্ন কিছু দেওয়া হতো, এই যেমন নাইওরী। বাপের বাড়ি থেকে দেওয়ার দর্শন ও ধারণা থেকে ইফতারি প্রথাও আমরা গ্রহণ করেছি হিন্দু ধর্মের দর্শন থেকে। ফলে সরাসরী না হলেও ভিন্নভাবে এই প্রথা হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। সূরা আহযাবের ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা (মুসলিমগণ) কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ-অনুকরণ করো না।” সুনানে আবু দাউদের ৪০৩১ নং হাদীসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভূক্ত বলে গণ্য হবে।’

দ্বিতীয়ত: ইফতারি প্রথার নামে যে পরিমাণ ইফতার সামগ্রী ও ফলমূল মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়, সেটা কি অপচয় নয়? অথচ ইসলামে অপচয় করতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অপচয়কারীর পরিণাম পৃথিবীতে তো বটেই, আখেরাতেও ভালো নয়। সূরা বনি ইসরাইলের ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।’’ এমন কথা সূরা মুমিনের ২৮ নং আয়াতেও বলা হয়েছে। ইফতারীর নামে যে পরিমাণ জিনিস পাঠানো হয়, সেটা কি মেয়ের স্বামীর বাড়ির লোকজন সহজে খেয়ে শেষ করতে পারে? খেয়ে শেষ করতে পারলেও সেটা বেশি নয় কি? কুরআনে খাবার সামগ্রী অপচয় করা কিংবা বেশি খাবারের বিষয়ে বলা হয়েছে। সূরা আ’রাফের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আহার করো ও পান করো; কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ 

ইসলাম বিরোধী অপচয়ের প্রথা অব্যাহত রেখে রোজা আসলে পাপ শুরু করে সিলেট অঞ্চলের মুসলমান। রমজানের প্রথম দিনই এই পাপের শুরু।

এই প্রথা বন্ধ করতে হবে। স্বামী হিসেবে আপনি ঘোষণা করুন যে, শ্বশুর বাড়ীর ইফতারি আপনি গ্রহণ করবেন না। স্বামীর বাড়ির অন্য যারা আছেন, তারাও এই ঘোষণা দিন। জৈন্তাপুর উপজেলার ভিত্রিখেল গ্রামের নববিবাহিত যুবক ইসমাইলকে সেদিন ফেসবুকে দেখলাম এমন ঘোষণা দিতে। ধন্যবাদ ইসমাঈলকে। যারা প্রবাসে আছেন, তারা তদের পরিবারকে বুঝান। প্রবাস থেকে ইফতারির জন্য বাড়িতে আলাদা বাজেট পাঠানো বন্ধ করুন।

এই ইফতারি প্রথা যে সামাজিক কুসংস্কার, বিধর্মীদের অনুসরণ এবং অপচয়-- এই বিষয়ে কথা বলুক মসজিদের ইমামেরা, আলেম-উলামারা। তারা বলুক যে, ইফতারি প্রথা মেইনটেইন করা পাপ কাজ। কোন ধর্মপ্রাণ-রোজাদার মুসলিমেরই উচিত নয় মেয়ের বাপের বাড়ির ইফতারী গ্রহণ করা। ইফতারি প্রথাকে না বলুন।

লেখক:পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়