Monday, April 6

ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় সোহাগপুরের বিধবাপল্লী


সুজন সেন:‘আমার স্বামী ও পুলারে যারা মারছে তাগোরে ফাঁসি দেইখ্যা মরবার বড় আশা মনে আছিল। আইজ কামরুজ্জামানের ফাঁসির সাজার কতা হুইন্না বুহের ভিতর থাইক্কা একটা চাপা দেওয়া পাত্তর হইরা (সরে) গেলো।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ খেজুর আলীর স্ত্রী জরিতন বেওয়া। যিনি ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বামী, সন্তান-স্বজনসহ পরিবারের স্বজনদের হারিয়েছিলেন। আর যে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিলেন আলবদর কমান্ডার মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। জরিতন বেওয়া বলেন, ‘আমার স্বামীরে ঘর থেইক্যা টাইন্যা লইয়্যা আইয়্যা উঠানে ফালাইয়্যা পরথমে ছয়ডা গুলি করে। গুলি খাইয়্যা পানি চাইলে আরেকটা গুলি করে। ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়। পরে আমার সোনা মানিক বুকের ধন হাশেমরে ধইর‌্যা নিয়্যা বাপের লাশের উফরে ফালাইয়্যা গুলি করে। এরপর আমার দেওররে ধইর‌্যা নিয়্যা বন্দুকের নল দিয়্যা কেচাইতে থাহে, পরে মুহের ভিতরে বন্দুক দিয়্যা গুলি করে। তহনি তার পরান বাইরইয়্যা যায়।’ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহাল থাকায় নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের বিধবা ও শহীদ স্বজনদের চোখে আনন্দাশ্রু বইছে। তাদের এখন একটাই অপেক্ষা কখন হবে কামারুজ্জামানের ফাঁসি। শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া বলেন, ‘যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগর নেতা কামরুজ্জামানের ফাঁসির সাজা অইছে, হুইন্না আংগর কইলজাডা তাও ইট্টু জুড়াইছে।’ সেদিনের সেই হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ জসিমুদ্দিনের স্ত্রী বিধবা নুরে মান বেওয়া, বিধবা সমলা বেওয়া ও করফুলি বেওয়া। তারা বলেন, ‘পাক বাহিনীরাতো আর আমগর এলাকা চিনতো না। রেজাকার-আলবদররাইতো তাগরে পথ দেহাইয়া এই গেরামে মুক্তি আছে কইয়া আনছে, ম্যাছাকার করছে। আমগরে বিদুফা (বিধবা) করছে, স্বামী-সন্তানহারা করছে। কামারুজ্জামান আছিল ওগরে নিডার (নেতা)। অহন অক্তের (রক্তের) বদলে কামারুজ্জামানের অক্ত (রক্ত) নেওয়ার ফাঁসির সাজা অইছে, আমরা খুশি অইছি।’ তবে শহীদ ছফির উদ্দিনের দুই ছেলে জালাল উদ্দিন ও আলাল উদ্দিন বলেন, ‘কামরুজ্জামানের ফাঁসির রায়ে আমরা খুশি। বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের স্বজনরা সবাই খুশি। তবে আমরা এহন কিছুডা ডরের (আতঙ্কের) মধ্যে আছি। কামরুজ্জামানের পক্ষের লোকেরা নানাভাবে আমাদেরকে শায়েস্তা করা হবে, ক্ষমতা পরিবর্তন হলে দেখে নেওয়া হবে বলে নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে।’ ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানি বাহিনী বর্বর গণহত্যা চালায় জেলা শহর শেরপুর থেকে ৩৬ কি. মি. দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদরদের ৬ ঘণ্টার তাণ্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। এদিন ভোরে পাক বাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষদের। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘বিধবাপল্লী’। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের নির্দেশে সোহাগপুর গ্রামে এ গণহত্যা সংগঠিত হয়। শহীদ পরিবারের বিধবারা বলেন, ‘আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নির্দেশে স্থানীয় রাজাকার কাদির ডাক্তারের নেতৃত্বে গ্রামের প্রফুল দিঘী থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা গ্রামের ছেলে, বুড়ো, শিশু যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। অনেককেই বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। মধ্যযুগীয় কায়দায় নরঘাতকের দল স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে সন্তানকে বাড়ির উঠানে ফেলে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। প্রায় ৬ ঘণ্টা তাণ্ডবের পর হায়েনার দল সোহাগপুর গ্রাম ত্যাগ করে চলে যায়। সোহাগপুরের শহীদ পরিবারে বর্তমানে ৩৪ জন বিধবা রয়েছে। তারা কামারুজ্জামানের পাশাপাশি স্থানীয় রাজাকারদেরও বিচার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। --------- ঢাকাটাইমস

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়