Friday, March 27

স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজ


মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ: ভারতবর্ষে ইংরেজবিরোধী সব সংগ্রাম, পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন এবং সে পথ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি স্বৈরশাসন বা জঙ্গিবাদের উত্থান সবসময় আলেম সমাজ ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন এবং আম জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন দ্বীনি দায়িত্ববোধ থেকে। বিশেষ করে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে এদেশের আলেমদের ইতিবাচক ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। যুদ্ধকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর সাক্ষাৎকার, যা মার্কিন টেলিভিশন এবিসির মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক বব ক্লার্কের এক প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধে জনগণের পাশে ছিলেন এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আগা শাহী যখন পূর্ব পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞের অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন তখন তার প্রতি বব ক্লার্কের প্রশ্ন ছিল, 'জনাব রাষ্ট্রদূত, গণহত্যার অভিযোগ কিন্তু নানা সূত্র থেকে এসে পেঁৗছেছে। এসব সূত্র হচ্ছে বিদেশি কূটনীতিবিদ, ধর্ম প্রচারক ও সাংবাদিক। এরা কিন্তু আপনাদের সশস্ত্র ব্যবস্থা গ্রহণের আগে থেকেই ঘটনাস্থলে ছিল। পাকিস্তান থেকে সীমান্তের ওপারে যেসব শরণার্থী চলে গেছে, তাদের বক্তব্যের সঙ্গে এদের গণহত্যার বিবৃতির মিল থাকাটা কি অর্থবহ নয়? (এমআর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি, পৃষ্ঠা নং-১৬৭)। আলেম সমাজ যে শুধু যুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছেন তা নয়, বরং ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত-পাকিস্তান ভাগ করে চলে যাওয়ার সময় যখন নেতারা একটা স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রাপ্তির সাফল্যে সন্তুষ্ট তখন একজন আলেম পূর্ব-পশ্চিমের এ সংযুক্ত বিভাগকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে থাকেন এবং এ ভূখন্ডের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন। তিনি হলেন মাওলানা মোহাম্মদ শামসুল হুদা পাঁচবাগী। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা নামক গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ লিখেছেন, মাওলানা পাঁচবাগী পাকিস্তান প্রস্তাবের (১৯৪৩) বিরোধী এবং স্বাধীন বাংলার প্রবক্তা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মৌলভি আবুল হাশেম, বেঙ্গল কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা কিরণ শংকর রায় প্রমুখ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলেন। কিন্তু সেই দাবি কংগ্রেসের কাছে সমর্থন লাভ করেনি এবং গোটা বাংলা-আসামকে পাকিস্তানভুক্ত করার যে দাবি মুসলিম লীগের ছিল, তাও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট মেনে নেননি। হাশেম-সোহরাওয়ার্দী ও কিরণ শংকরের স্বাধীন বাংলা কায়েমের দাবির বেশ আগেই মাওলানা পাঁচবাগী তার প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা কায়েমের দাবি পেশ করেছিলেন। এ নিরিখে তাকে বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার সর্বপ্রথম দাবিদার বা স্বপ্নদ্রষ্টা বলা চলে। স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগঠকের ভূমিকাতেও আলেম সমাজের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ পর্যায়ে আমরা স্মরণ করতে পারি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের কথা। মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন ভারতের দেওবন্দ মাদরাসায় পড়া একজন আলেম। তিনি ছিলেন একাধারে একজন বিজ্ঞ সংগঠক ও যোদ্ধা। তার সম্পর্কে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ লিখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মাওলানা তর্কবাগীশ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি 'ওলামা পার্টি' গঠন করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন ওই পার্টির সভাপতি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গণপরিষদের ১ম বৈঠকে মাওলানা তর্কবাগীশ সভাপতিত্ব করেন। এখান থেকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তার সভাপতিত্বেই সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ইত্যাদি নির্বাচিত হন। (রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা, পৃষ্ঠা-২০৪)। সম্মুখ সমরে অগ্রগামী হয়ে আহত হয়েছেন, শহাদাতবরণ করেছেন এমন আলেমের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট গবেষক আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের লেখা থেকে আমরা দুই-একটি উদাহরণ পেশ করছি। তিনি লিখেছেন, 'একইভাবে তারা রাজবাড়ী জেলখানার মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধারা বিহারিদের রাজবাড়ী জেলখানায় আটক করার পর মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলী তাদের পাকিস্তানপ্রীতি ত্যাগ করে জয় বাংলার প্রতি সমর্থন জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী দখলের পর বিহারিরা ছাড়া পেয়ে মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে হত্যা করে। এপ্রিলের শেষ দিকে ইয়াকুব আলী কাজীকান্দাস্থ নিজ বাড়ি থেকে শহরাভিমুখে আসার পথে অবাঙালিরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে বিহারিরা গলা কেটে করে হত্যা করে। তারপর তার পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে দিয়ে বলে, 'আভি শালা জয় বাংলা বোলো।' (মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৬১)। পাবনা সদরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন শহীদদের যে তালিকা বলেছেন, তার মধ্যে বিশিষ্ট একজন হলেন মাওলানা কসিম উদ্দিন। (মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-১৪৮)। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলব অথচ ওলামায়ে কেরামের কথা বলব না, তা হয় না। অবশ্যই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের অবদানের বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত হতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের এক মহান দায় চিরদিন আমাদের কাঁধে থেকে যাবে। এখনও বহু মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখা সে সময়ে পূর্ণবয়স্ক ও বুদ্ধিসম্পন্ন বহু নাগরিক, যারা আজও বিশেষ কোনো রাজনীতির লেবেল পরেননি, কোনো ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়া তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করেন। তাদের স্মৃতি ঘেঁটে এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা সব গ্রন্থের সহায়তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি শুরু করতে আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্রেরই উচিত জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে মহান উদ্যোগটি গ্রহণ করা। লেখক : খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়