Tuesday, February 10

রিবা ও ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস?


মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ খন্দকার: ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, অর্থনীতির জন্য স্থিতিশীল ও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থাকে আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত 'ফ্রড' বলে উল্লেখ করেছেন। পত্রপত্রিকায় দেখেছি তিনি জাতীয় সংসদে হাবিবুর রহমান মোল্লার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, 'ইসলামী ব্যাংকিং প্রথম থেকেই আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা একান্তই ফ্রড এবং সেভাবেই এটাকে সবসময় বিবেচনা করেছি। ... তিনি আরও বলেন, ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। রিবা এবং বর্তমান সুদ এক জিনিস নয়। রিবা চক্রবৃদ্ধি সুদ। রিবার মধ্যে কোনো ধরনের মানবিক চিন্তাধারা নেই। কিন্তু সুদ মানবিক চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুদ হলো কস্ট অব ফান্ড এবং কস্ট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। কিন্তু রিবাতে সেটা ছিল না। যারা ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলেন তারা সুদ ও রিবাকে এক করে ফেলেন। এটা একান্তই ভুল এবং এ ভুলের ওপর ভিত্তি করেই ইসলামিক ব্যাংকিং হয়েছে।' ক. ইসলামী ব্যাংকিং কি ফ্রড? নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গৌরব আবুল মাল আবদুল মুহিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন অর্থনীতিবিদ ও দেশের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ। আমি তার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, তার ওই অভিমত আমার কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক কী কারণে ফ্রড তা তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রুলস-রেগুলেশন্স, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং স্ট্যান্ডার্ড_ ব্যাসেল-২ ও মানিলন্ডারিং আইনসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন পরিপালনে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক থেকে এগিয়ে রয়েছে। এছাড়া দেশের বহু সুদি ব্যাংক যখন ঋণদানে অনিয়ম ও দুর্র্নীতি করে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছেছে তখন ইসলামী ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবদান খ্যাতিমান সবার কাছেই স্বীকৃত। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদের বিকল্প হিসেবে লাভ-লোকসানে অংশীদারি পদ্ধতি, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা বা ভাড়া ইত্যাদি শরিয়াসম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করে। তারা কোনোভাবেই ইসলামের নামে সুদের ব্যবসা করে না। তাই এক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকিংকে 'ফ্রড' বলা সমীচীন নয় বলেই মনে হয়। খ. আল কোরআনের রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস? অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আরও একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে তা হলো, আল কোরআনের রিবা আর প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ এক নয়। সম্ভবত তিনি আল কোরআনে উলি্লখিত রিবাকে নিষিদ্ধ বললেও ব্যাংকিং সুদকে বৈধ মনে করেন এবং ব্যাংকিং সুদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলেই তার ধারণা। প্রকৃতপক্ষে আল কোরআনের রিবা এবং ব্যাংকিং সুদ একই জিনিস এবং উভয়ই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। 'সুদ' একটি উর্দু শব্দ, পবিত্র কোরআনে যা 'রিবা' শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় রিবার অর্থপ্রকাশক উপযুক্ত প্রতিশব্দ না থাকায় এর অনুবাদ করা হয় 'সুদ' শব্দ দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে রিবা শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থবোধক। আর প্রচলিত সুদ সেই ব্যাপক অর্থের একটি অংশ মাত্র। সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউজারি (ঁংঁৎু) বা ইন্টারেস্ট (রহঃবৎবংঃ)। আল কোরআনে ব্যবহৃত 'রিবা' পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল 'রাবউন' থেকে উদ্ভূত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাই রিবা বা সুদ। আবার একই শ্রেণীভুক্ত পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের সময় চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করা হয়, তাকেও রিবা বা সুদ বলা হয়। সুদ প্রধানত দুই ধরনের। প্রথম হলো রিবা আন নাসিয়াহ বা মেয়াদি সুদ। আরবি 'নাসিয়াহ' শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীক্ষা। রিবা নাসিয়াহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ। যেমন_ কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে রিবা বলা হবে। আল কোরআনে উলি্লখিত এ রিবাকেই রিবা আন নাসিয়াহ বা রিবা আল কোরআন বলা হয়। আর দ্বিতীয় রিবা হলো, রিবা আল ফদল। আরবি 'ফদল' শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কম-বেশি করে আদায় করার নাম রিবা আল ফদল। অর্থাৎ একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছে থেকে চুক্তি মোতাবেক শরিয়াসম্মত বিনিময় ব্যতীত যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবা আল ফদল বলে। যেমন_ এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সঙ্গে দেড় কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা। রিবা আল ফদলকে মালের সুদও বলা হয়। আল কোরআনে রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আর হাদিসে সুদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রাথমিক যুগের মুফাসসেররা রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন। প্রখ্যাত মুফাসসের জারির ইবনে আত-তাবারি মুজাহিদের সূত্রে জাহেলি যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণিত হাদিস উল্লেখ করেছেন, 'জাহিলি যুগে কোনো ব্যক্তি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। অতঃপর সে ঋণদাতাকে বলত, আমি এত এত পরিমাণ বেশি দেব, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও।' এছাড়া হাদিসে রিবা বা সুদের সংজ্ঞায় আরও বলা হয়েছে, 'যে ঋণ মুনাফা টেনে আনে তাই রিবা বা সুদ।' হাদিসে আরও বলা হয়েছে, 'সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। বেশি-কম করলে বা বাকিতে করলে, তা সুদি কারবার বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী হবে।' ইমাম আবু বকর আল জাস্সাস তার বিখ্যাত তাফসির আহকামুল কোরআনে রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন_ 'জাহিলিয়াতের সময় সুদ ছিল, কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রদত্ত ঋণের আসলের ওপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত অতিরিক্ত।' ইমাম ফখরউদ্দিন আল রাজি জাহিলিয়াতের যুগের রিবা সম্পর্কে বলেছেন, 'জাহিলিয়াতের যুগে রিবা আন নাসিয়াহ ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত, কিন্তু আসল ঠিক থাকত। অতঃপর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে আসল অঙ্ক ফেরত চাইত। ঋণগ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।' উপরে রিবার যে সংজ্ঞা পেশ করা হয়েছে তার সঙ্গে বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংক সুদের কোনো পার্থক্য নেই। কেউ কেউ বলেন, পবিত্র কোরআনে কেবল ভোগ্যঋণের সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু বাণিজ্যিক ঋণের সুদ নিষিদ্ধ নয়। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, বাণিজ্যিক ঋণ নেয় ধনীরা এবং এ ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। তাই ভোগ্যঋণ দিয়ে সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে যে বেইনসাফি ও অমানবিকতা রয়েছে তা উৎপাদনশীল বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে নেই। সুতরাং বাণিজ্যিক সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। তাদের এ বক্তব্য মোটেও সঠিক নয়। কেননা, পবিত্র কোরআনে সুদ সম্পর্কে যেসব আয়াত এসেছে সেখানে সুদের কোনো শ্রেণীবিভাগ করা হয়নি। ফলে সব ধরনের সুদই হারাম। ব্যাংকিং সুদ, ভোগ্যঋণের সুদ ও বিনিয়োগ সুদ বা ব্যবসার জন্য গৃহীত ঋণের সুদের মধ্যে পার্থক্য করার বিষয়টি একটি নতুন ধারণা। এ ধারণার প্রবর্তকদের মতে, শুধু ভোগ্যঋণের সুদ হারাম আর ব্যাংকিং সুদ বা বিনিয়োগ সুদ হালাল। তাদের এ ধারণা উম্মাহর সব আলেম ও ফকিহদের মতামত থেকে ভিন্ন। তাদের মতের ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহর সমর্থন নেই। কেননা, মহান আল্লাহ সব ধরনের সুদ হারাম করেছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের চূড়ান্ত ঘোষণা, 'আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।' বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফলতা লাভ করেছে। এ মানবদরদী, কল্যাণধর্মী ও সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নে দরদি মনোভাব নিয়ে সবার এগিয়ে আসা উচিত। লেখক : গবেষক, গবেষণা বিভাগ, ইসলামী ব্যাংক

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়