Monday, February 2

ফতোয়া কী ও কেন


মুফতি আল আমিন ও মুফতি আবদুল লতিফ: ফতোয়া একটি ইসলামী পরিভাষা। আরবি ফাতাবির বহুবচন ফতোয়া। এটি একবচন হিসেবে ফুতয়ারূপে ব্যবহৃত হয়। ফকিহ কর্তৃক প্রদত্ত অভিমত হলো ফতোয়া। ইমাম আবু রাগিব ইসফাহানি (রহ.) বলেন, 'জটিল বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধান হলো ফতোয়া।' আধুনিক পন্ডিতরা বলেন, 'ফতোয়া হলো ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক আইনগত মতামত প্রদান।' এটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো- সিদ্ধান্ত, মতামত, রায় ইত্যাদি। আল মাওরিদ অভিধানে ড. রুহি বালাবাক্কি বলেন, ফতোয়া অর্থ legal opinion (আইনি মতামত); advisory opinion (উপদেশমূলক মতামত)। প্রফেসর ড. আহমদ মুখতার উমার বলেন, ফতোয়া হলো শরিয়া বা আইনি কোনো জটিল প্রশ্নের জবাব। ফতোয়া চাওয়াকে আরবিতে ইস্তিফতা এবং ফতোয়া দেয়াকে ইফতা বলে। আর যিনি ফতোয়া প্রদান করেন তাকে মুফতি বলে। কোরআন মাজিদে এসেছে 'ওয়া ইয়াস্তাফতুনাকা ফিনি্নসায়ি, কুলিল্লাহু ইউফতিকুম ফিহিন্না- তারা আপনার কাছে মহিলাদের সম্পর্কে ফতোয়া চায়, আপনি বলুন, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাই তোমাদের ফতোয়া দেবেন।' (সূরা নিসা : ১২৭)। ইসলামে মুফতিকে আল্লাহর বিধান বয়ানকারী মনে করা হয়। পবিত্র কোরআনে ফতোয়া শব্দটি জিজ্ঞাসার জবাব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ইউসুফ (আ.) এর আমলে মিসরের বাদশাহ একটি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে তার সভার গুণীজনদের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে 'আফতুনি ফি রুইয়া' (আমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যার ব্যাপারে ফতোয়া দাও) বলেছিলেন। মহিলাদের বিয়ে ও মোহরানা সম্পর্কে প্রশ্ন করা সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে আল কোরআনে ফতোয়া শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। সন্তানহীন ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন নীতি নিয়ে প্রশ্ন করা সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়েও কোরআনে ফতোয়া শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা নিসার ১৭৬নং আয়াতে বলা হয়েছে- 'তারা আপনাকে ফতোয়া জিজ্ঞেস করে, আপনি বলুন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কালালাহ বা সন্তানহীন ব্যক্তি সম্পর্কে ফতোয়া দেবেন।' ফতোয়ার পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কে ইমাম রাগেব ইস্পাহানি (রহ.) বলেন, জটিল শরীয় মাসয়ালার সমাধানমূলক জবাবকে ফতোয়া বলে। ইমাম করাফি (রহ.) বলেন, ফতোয়া হলো- 'কোনো কাজ বৈধ বা অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর বিধান জানিয়ে দেয়া।' (আলফুরুক, ৫৩/৪)। আল্লামা বুহুতি (রহ.) বলেন, প্রশ্নকারীর সামনে দলিলের মাধ্যমে শরিয়ার বিধান ব্যাখ্যা করাকে ফতোয়া বলে। (শরহুল মুনতাহি, পৃ. ৪৫৬)। সাধারণত শরিয়ার দৃষ্টিতে কোনো কিছুর হালাল, হারাম, মাকরুহ, মোস্তাহাব ইত্যাদি হওয়া সংক্রান্ত জবাবকে ফতোয়া বলা হয়। যদিও ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যে কোনো বিষয়ের জটিল প্রশ্নের জবাবকে পরিভাষায় ফতোয়া বলা হয়। কেননা ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানব জীবনের যাবতীয় দিকের দিকনির্দেশনা অতি সুন্দরভাবে এখানে বর্ণিত আছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রের সমস্যার সমাধান খোদায়ি বিধান অনুযায়ী কী হবে, তা এখানে রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, সব মানুষ এসব সমস্যার সমাধান জানে না। যেমন হাদিস শরিফে আছে, মহানবী (সা.) বলেন, 'হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। তবে এ দুইয়ের মধ্যে কিছু অস্পষ্ট বিষয় রয়েছে, অধিকাংশ মানুষ জানে না, তা কি হালালের অন্তর্ভুক্ত হবে নাকি হারামের অন্তর্ভুক্ত হবে।' (জামে তিরমিজি : ১২০৫)। এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, কিছু মানুষ শরিয়াসংক্রান্ত নানা মাসয়ালার সমাধান দেয়ার ক্ষেত্রে পারদর্শী হবে। তখন বাকি মানুষের দায়িত্ব কী হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমরা যদি না জানো তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো।' (সূরা নাহল : ৪৩)। ফতোয়ার ভিত্তি ফতোয়ার ভিত্তি চারটি- কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস। রাসূল (সা.) যখন মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) কে ইয়ামেনের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তখন মুহাম্মদ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কী দিয়ে তুমি বিচার করবে? তিনি উত্তরে বললেন, 'আল্লাহর কিতাবের দ্বারা করব।' তখন মুহাম্মদ (সা.) বললেন, 'যদি কোরআনেও তার সমাধান না পাও তাহলে তার সমাধান কীভাবে করবে?' তখন মুয়াজ (রা.) বললেন, 'হাদিসের দ্বারা।' তখন রাসূল (সা.) বললেন, যদি তার সমাধান হাদিসে না পাও তখন কী করবে? তখন সে উত্তরে বললেন, আমি তা আমার বিবেকের সাহায্যে সমাধান করব।' তার এ জবাব শুনে রাসূল মুহাম্মদ (সা.) সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন আর আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এককথায় ফতোয়া হলো প্রশ্নের জবাব। তা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কিত বিষয় হতে পারে, রাজনৈতিক বিষয় হতে পারে আবার যে কোনো বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরের নাম হলো ফতোয়া। মানব জীবনের যে কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ইসলামী জিজ্ঞাসার নাম ফতোয়া।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়