Friday, December 19

মিলাবে, মিলিবে


ক্রিস, ক্রিস্টিন আর ইউকো। বয়সে খুব তরুণ। একেকজনের বাড়ি একেক দেশে। মিল হচ্ছে, তারা সবাই ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজের ছাত্রছাত্রী। তারা ঠিক করে ছুটিতে দক্ষিণ এশিয়ায় আসবে এবং বাংলাদেশেই। তারা একটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভে বাংলাদেশের অতিদরিদ্র শিশুদের বেড়ে ওঠা জীবন কাহিনীর খোঁজ পেয়েছিল এবং ঠিক করে, এ সময় তাদের কারও কারও সঙ্গে দেখাও করবে, যাদের যাদের সঙ্গে সম্ভব। তাদের একজন লাকু। লাকু মান্দি জনগোষ্ঠীর। ক্লাসের হিসেবে তার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও জীবিকার তাগিদে এখন ঢাকায়। কথা বলার সময় যদি পাশে বসে থাকি, তবে নিঃসঙ্কোচে লাকু কথা বলবে। এভাবেই শুরু হয় যোগাযোগের যোগসূত্র। সেদিন বৃষ্টি। পেঁৗছে গেছি। লাকু তখনও কাজ থেকে ফেরেনি। অপেক্ষা করছি। এ কী, দেখি রীতিমতো আমার সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু করেছে! জানতে চায়, বাংলাদেশে আদিবাসীদের অবস্থা কেমন? ঘরে কোনো অতিথি এলে দুর্নাম করতে নেই। বলি, ভালোই আছি_ পাকিস্তান, আফগানিস্তানে কত অস্থিরতা, কত মানুষ মারা যাচ্ছে! আলাপে আলাপে জানায় তারা ১৫ দিন থাকবে। সঙ্গে অর্থপূর্ণ কিছু করতে চায়, ভলান্টারি ওয়ার্ক। তাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভবপর হয়ে ওঠে, বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে যদি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিখতে সহায়তা করা যায়_ এমন ভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করছে। তোমার কোনো কাজ থাকলে দিতে পার! আমি আবার কোত্থেকে দিমু? নিজেই পাই না_ অবস্থাটা যখন এমন। জিজ্ঞাস করে, তুমি কি আমাদের জন্য সময় দিতে পারবা? _আলবৎ। তবে মাঝখানের কয়েকটা দিনে থাকতে পারব না। ঢাকায় তাদের প্রথম অভিজ্ঞতাগুলো জানতে চাই। রাস্তায় প্রথম প্রথম নেমে তাদের নাকি খুব ভয় করত! কোনোকিছুর জন্য না, শুধু মানুষের ঘনত্বের জন্য, ভিড়ের জন্য। শুনে হাসি পায়। আরেকটা কথা জানায়, মনে হয়েছিল কেউ যদি মানুষের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যেতে চায়, তবে তা-ও বোধ হয় সম্ভব হবে! হাসি চেপে রাখতে পারি না। সত্যি, একসঙ্গে এত মানুষের দেখা পেতে চাইলে আমাদের দেশে মাসের পর মাস চলে যাবে, হয়তো বছরও লাগতে পারে। মাঝখানে সিরাজগঞ্জ যাই, এসে জিজ্ঞেস করি, কই কই ঘুরলা? _ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনার, জাতীয় সংসদ আর সচিবালয়। ক্রিসের বাড়ি বিলেত। লিভারপুল শহরে। লিভারপুল ফুটবল টিম, তাই তার কাছে আমাদের 'পাড়ার টিমে'র মতো। প্রিয় খেলোয়াড়দের তালিকায় দেখি সুয়ারেজের নামও আছে। সুয়ারেজের কামড়-কা- তখন মাথায় ছিল না। না হলে নিশ্চয়ই এ নিয়ে কমপক্ষে একটি প্রশ্নের হাত থেকে রেহাই পেত না। এ নিয়ে পরে কবি নির্মলেন্দু গুণের_ 'তারা ঠিকমতো ভালোবাসতেও শেখেনি, ঘৃণা করতেও শেখেনি। না হলে কামড় দেয়ার পর কেন তার দাম আরও বেড়ে যাবে। কেন অন্য ক্লাবগুলো বেশি দাম দিয়ে তাকে কিনে নিতে চাইবে?' বাক্যটি মনে পড়ে। বিশ্বকাপ ফুটবলবিষয়ক এক আলোচনায় তিনি কথাটি বলেছিলেন পাশ্চাত্যের ভেঙে যাওয়া পরিবার, অনাচার, কামড়-কা-_ এসব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে। কলেজ কাউন্সিলে কোনোদিন নির্বাচন না করলেও প্রতিটি কাজে সে খুব সক্রিয়, তাই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সবার কাছে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, তার বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি। সে সাম্যবাদের অনুসারী। প্রিয় বইয়ের তালিকায় দেখি, দাস ক্যাপিটাল, দি আনরেস্ট রোলার, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোও আছে। তোমার দেশে সমস্যা কী? _প্রয়োজনের তুলনায় সব সময়ই রাজতন্ত্রকে, রানীকে গুরুত্ব দিয়ে রাখে। হাইড পার্কের প্রসঙ্গ তুলি। সেখানে গিয়ে নাকি সবাই যার যার মত প্রকাশ করতে পারে, কথা বলতে পারে? কোনো দিন সে ধরনের কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছ? _দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনেছি দু-তিনবার। এসব নানা কথার খুনসুটিতে তাদের সঙ্গে সময় কাটতে থাকে। আমাদের দেশের সংস্কৃতিই হচ্ছে কাউকে ডাকার আগে কোনোকিছু সম্বোধন করে ডাকা। সে মোতাবেক ড্রাইভার মামাকে ডাকতাম সেলিম মামা। একদিন আচমকা ক্রিস্টিন প্রশ্ন করে বসে_ আচ্ছা, তোমরা কথায় কথায় সম্পর্কগুলো ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে আস কেন? যেমন মামা, খালা, ভাই? সেলিম মামা জানতে চায়_ কী জিগাইল? শোনার পর সেলিম মামাও পাল্টা প্রশ্ন করে_ তোমরা কি নামে ডাক? _আমরা তো নাম ধইরাই ডাকি। আরেকজন আগ বাড়িয়ে বলে, আমাদের এখানে স্কুল-কলেজে টিচারদেরও নাম ধইরা ডাকা হয়। যেমন মি. মিলার বা মিসেস মিল। বড় অদ্ভুত-বিদঘুটে আর সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল বোধ হয় সেলিম মামার। আইচ্ছা কও, তোমরা বাপ-মারে কেমনে কইরা ডাক? স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়ে_ যেখানে শীতকালে সূর্য থাকে না, গরমকালে দিন বড়, রাত খুব কমই হয়। ক্রিস্টিন একটু চঞ্চল প্রকৃতির। অসম্ভব স্পষ্টবাদী। আমাদের বাংলা বাগ্ধারার 'ঠোঁটকাটা'দের দলেও সে পড়ে যেতে পারে। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে যেসব প্রসঙ্গ সবাই এড়িয়ে যেতে চায়, সেসব বিষয়ও নিঃসঙ্কোচে বলে ফেলে। সে থাকে হোস্টেলে। বাবা-মায়ের সেপারেশন হয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে দুজনেরই। বলে 'বাবার বউ!' ভদ্রতা রেখে ছোট ভাইদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে ফেলবে, তারা তো আমার আপন ভাই না। থাক, সেসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। 'নওরেজিয়ান উড' উপন্যাসটি জানে, পড়ার সুযোগ হয়নি এখনও। একবার শুনেছিলাম, তোমাদের সংসদ ভবনে সর্বসাধারণ নাকি প্রবেশ করতে, ঘুরে দেখতে পারে? _হ্যাঁ। আদিবাসী প্রসঙ্গও আসে। সামি। দেশের উত্তরাংশে থাকে। জনসংখ্যা সব মিলিয়ে ৫০ হাজারের মতো হবে। সুইডেন আর ফিনল্যান্ডেও আছে কিছু। নরম সুরে জানায়, জান, আমাদের দেশে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কোণঠাসা বলা যায়। তাই তো শহর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে এখন শুধু গ্রামাঞ্চলে তাদের দেখা পাওয়া যায়। আমার এক নানি আছে, দেখতে একদম সামিদের মতো। তাকে দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে, সে 'সামি' নয়। আর সবাই তার সঙ্গে মজা করে বলে, তুমি তো সামি। চেনার একটা উপায় বাতলায়, তাদের চুল একবারে ব্রাউন হবে না, উজ্জ্বল ব্রাউন হবে বা কালচে হওয়ার একটা ভাব রয়ে যাবে; নাক দেখলেও চেনা যায়। অফিসিয়ালি সামি না হলেও স্বীকার করে, সামিদের রক্ত তার শরীরেরও বইছে, এ-ই হলো ক্রিস্টিন, তার স্বভাব। সূর্যোদয়ের দেশের কন্যা ইউকো। সিরিয়াস যে কোনো কাজে, আর ক্লান্তিহীন; এই বুঝি গোপন মন্ত্র জাপানিদের জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার। একটা ছোট বই সঙ্গে নিয়ে এসেছে বাংলা শেখার। কথোপকথনে সবার সঙ্গে চেষ্টা করে ভাঙা ভাঙা ছোট ছোট বাক্যে সংযোগ ঘটানোর। 'আমার নাম ইউকো', 'আমি জাপান থেকে এসেছি'_ এমনসব বাক্যে। জাপানি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির কয়েকটি ছোটগল্প বাংলা অনুবাদে পড়েছি জানালে খুশি হয়। সঙ্গে নিয়ে এসেছে একগাদা 'অরিগামি'। ছোট হালকা কাগজ, যা দিয়ে ফুল-পাখি তৈরি করা হয়। যখনই সুযোগ পায়, রাস্তার ধারে গাছের ছায়ায় কিংবা শ্রেণিকক্ষের ভেতর সে নানা রকমের ফুল-পাখি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একেকটা বানানোর পর ছোট বাচ্চাদের উপহার দিতে থাকে। তাই যেখানে যায়, সেখানেই অল্প সময়ে বিশাল শিশু ভক্তশ্রেণী তৈরি হয়ে যায়! দাম জানা গেলে আমাদের আর্টপেপারগুলোর সঙ্গে তুলনা করে জানা যাবে, সেটি দামে সস্তা নাকি দামি_ তা-ই জানতে চাই। হেসে জানায়, তার ভাইয়ের ছোটবেলা যে অরিগামি কেনা হয়েছিল, সেগুলো বাড়িতে রয়ে গিয়েছিল বাড়তি। সেগুলোই সে নিয়ে এসেছে। অর্থ জানায়, 'অরি' হচ্ছে ভাঁজ করা 'গামি' মানে কাগজ। তোমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম জানি কী ছিল? _'কিমোনো।' বিদেশে থাকার সময় কী পর? বিলেত তো তোমার জন্যও বিদেশ? মাঝে মাঝে, কোনো অনুষ্ঠান হলে সেটা পরতে কিন্তু একটু ভারিও লাগে। আদিবাসী প্রসঙ্গও বাদ যায় না। জাপানের 'আইনু'। উত্তর দিকে ছোট দ্বীপ হোক্কাইডোতে থাকে। তাদের ভাষা পৃথিবীর বিপণ্নপ্রায় ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন ধর্ম সিনথোইজম সম্পর্কে আলাপ চলতে থাকে, জীবনে আসে প্রচুর উৎসব। তাদের ঈশ্বর 'কামি'। আরেকটি মজার তথ্য জানায়, জাপানিদের জন্মের সময় যেসব আচার-প্রথা পালিত হয়, তার বেশিরভাগ প্রাচীন ঐহিত্য অনুসরণে করা, আর বিয়ের পর পর শুরু হয়ে যায় বুড্ডিস্ট রীতি অনুসরণ। ইউকো একটি গান শোনায়, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় এমন_ 'কেমন আছ বাবা-মা?/বন্ধুরা, যাদের স্পর্শ থেকে আজ বঞ্চিত/একদিন যখন আমার স্বপ্নগুলো পূরণ হবে/আমি ফিরে আসব।' গানটি শুনে ঢাকার গার্মেন্ট থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়িফেরা বোনদের মুখগুলো চোখে ভাসে... নিজের কথাও মনে হয়, বাড়ি ফিরে যাব একদিন...। ভিনদেশ, ভিনগ্রামের অচেনা এক দুঃখী শিল্পী রচেছিল বুঝি এই গান... তবু ছুঁয়ে যায়, শিল্পের শক্তি বুঝি এ-ই। তারা দুই বোন, এক ভাই। বড় বোন 'টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ' এ দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেছিল। তাই সে এ এলাকা সম্পর্কে ভালো জানে। কিছু ভাষাও বলতে পারে। বাংলাদেশে এসে ইউকো এত বেশি উচ্ছ্বসিত যে, ঠিক করে চেষ্টা করবে বড় বোনকে ম্যানেজ করার, যাতে জাইকার মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ নিয়ে বাংলাদেশে থাকে। সে সুবাদে সে-ও বাংলাদেশে বারবার আসতে-যেতে ও থাকতে পারবে। মনে মনে বিড়বিড় করি_ আসো, তবেই না আবার দেখা হবে! (একত্রে কলেজে পড়ুয়া তিন দেশের তিন শিক্ষার্থী এসেছিল বেড়াতে। তাদের সঙ্গে কাটানো সময়, এক সংস্কৃতির সঙ্গে আরেক সংস্কৃতির সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, মিল-অমিলের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে লেখা)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়