মাওলানা মুহাম্মদ মুহাররম হুসাইন
পশ্চিম দিগন্তে উদিত হতে চলেছে জিলহজের চাঁদ। শুরু হচ্ছে মোমিনের ইবাদত কর্মের এক উর্বর সময়। মহান আল্লাহ কিছু কিছু সময় এতটাই বরকতপূর্ণ করে বান্দাদের সামনে উপস্থাপন করেন, যে সময়ের সামান্যতম ইবাদতও তাদের আল্লাহর নৈকট্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। জিলহজ মাসের প্রথম দশক এ ধরনেরই একটি বরকতপূর্ণ সময়। এ সময়ের রাতগুলোর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য এখান থেকেই বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা এ রাতগুলোর নামে কসম করে বলেন '১০টি রাতের কসম'। (সূরা ফজর : ২)। তাই এ রাতগুলোতে মোমিন বান্দার চোখের ঘুম দূর হয়ে যাওয়া উচিত। এ কারণেই আল্লাহর খাস বান্দারা রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদের জন্য আরামের বিছানা ছেড়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। সাড়া দেয় তারা আল্লাহর সেই ডাকের 'কোথায় রিজিক সন্ধানী! আমার কাছে রিজিক চাও আমি রিজিক দেব, কোথায় অসুস্থ, যে রোগের সুস্থতা চাও, আমি সুস্থতা দান করব।' (মেশকাত)। বিশেষ করে এ রাতগুলোতে আল্লাহর মোমিন বান্দারা এশা ও ফজর নামাজ মহল্লার মসজিদে এসে জামাতের সঙ্গে আদায় করে। কারণ, তারা জানে যারা এশা এবং ফজর জামাতের সঙ্গে আদায় করে তারা সারারাত নফল নামাজের সওয়াব পায়। (মেশকাত)।
জিলহজের প্রথম দশকের দিনগুলোতে ফজিলতের কথা ব্যক্ত হয়েছে মহানবী (সা.) এর হাদিস শরিফে। এরশাদ হয়েছে, 'বছরের অন্য কোনোদিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে এতটুকু প্রিয় নয়, যতটুকু প্রিয় এ ১০ দিনের ইবাদত। এমন কী জিহাদের চেয়েও। তবে যারা জানমাল নিয়ে জিহাদ গিয়ে ফিরে আসেনি তাদের কথা ভিন্ন।' (বোখারি শরিফ)।
এ দিনগুলো সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমরা নির্ধারিত দিনগুলোতে আল্লাহর জিকির করো।' (সূরা হজ)। মহানবী (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, 'তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ পাঠ কর।' (মেশকাত)। তাহলিল মানে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।' আর তাকবির ও তাহমিদ মানে 'আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।' হজরত ইবনে ওমর ও আবু হুরায়রা (রা.) এ দিনগুলোর কোনো একদিন বাজারে গিয়ে দেখতে পেলেন, মানুষের মুখে কোনো তাকবির শোনা যায় না। তখন তারা চিৎকার করে এ তাকবির বলা শুরু করলে বাজারের সবাই সমস্বরে এ তাকবির বলা আরম্ভ করে দেন। বিশেষ করে ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ফরজ নামাজের পর একবার করে এ তাকবির পড়ার নির্দেশ এসেছে। ইমামের স্মরণ না থাকলে মুক্তাদি স্মরণ করিয়ে দেবেন। আর মহিলারা নির্জনে বসে নিম্নস্বরে পড়বেন। একে তাকবিরে তাশরিক বলা হয়।
জিলহজের প্রথম দশকে মহানবী (সা.) রোজা রাখতেন, অন্যদেরও রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বিশেষ করে নবম তারিখের রোজা প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, 'এ দিনে রোজা রাখলে আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছর এবং আগামী এক বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।' (মেশকাত)।
এ সময় বেশি বেশি দান-সদকার কথাও বলা হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বছরের অন্য সময়ের চেয়ে জিলহজের প্রথম দশক পৃথক বৈশিষ্ট্যম-িত। কারণ ইসলামের পাঁচটি রোকন সমভাবে এ দশকে আদায়ের সুযোগ থাকে। রমজান মাসে রোজার সুযোগ থাকলেও তো হজের সুযোগ পাওয়া যায় না।
জিলহজের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি কাজের কথা মহানবী (সা.) আমাদের স্মরণ করে দিয়েছেন 'যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে আর সে কোরবানি করার নিয়ত করে সে যেন তার নখ, চুল না কাটে।' (মেশকাত)। এতে তার ধ্যানমন হাজীদের চেতনায় আল্লাহর জন্য একাগ্র থাকে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলেন একজন মহিলা তার ছেলের চুল কাটছে। তিনি বললেন, 'হে মহিলা আর ক'টা দিন অপেক্ষা করে কোরবানির পর কাটলে তুমিও সওয়াব পেতে তোমার সন্তানও সওয়াব পেত।' (মুস্তাদরাক হাকেম)।
এ দিনগুলোতে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আরাফাত, মুজদালিফা, মিনা ও মক্কা-মদিনায় আল্লাহর দরবারে হাজির থাকেন। আমরাও কোরবানির প্রস্তুতি ও কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের চেতনাকে তাদের সঙ্গে একাকার করতে পারি। আল্লাহ পাক যেন আমাদেরও তার ঘরের জিয়ারত নসিব করেন
লেখক: খতিব, দার-উস-সালাম জামে মসজিদ, রাজশাহী
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়