Thursday, August 28

প্রাচীন স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন


রেজাউল করিম,টাঙ্গাইল: যে সব ঐতিহ্যের কারণে টাঙ্গাইলকে সহজেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় এর মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদ অন্যতম। আশির দশকে গভর্নর খোরশেদ আহম্মেদের সময়ে বাংলাদেশ সরকারের ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে জাতীয় সম্পদ হিসেবে মসজিদটি স্থান পাওয়ায় আরো সহজেই এটি পরিচিতি লাভ করে। ফলে মসজিদটি শুধু ঐতিহ্যের নিদর্শনই নয়, এটি একটি দর্শনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ৭ কিলোমিটার দূরে লৌহজং নদীর তীরে ঐতিহাসিক জামে মসজিদটির অবস্থান। এর নির্মাণ প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে হলেও এটি প্রাচীন স্থাপত্যের এক অনন্য শিল্পকর্মের নিদর্শন হিসেবে আজও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইতিহাসখ্যাত বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খানের শাসনামলে মসজিদটি নির্মিত হয়। ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। তিনি ছিলেন সোনারগাঁও অঞ্চলের শাসক। বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ তখন সোনারগাঁও অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শাসন কার্যপরিচালনার সুবিধার্থে ঈশা খাঁ টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়ায় পরগনা সৃষ্টি করেন। সে সময় আতিয়া পরগনার শাসনভার ন্যস্ত হয় ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খাঁর ওপর। প্রাচীন এই মসজিদটির আয়তন বাইরের দিকে ২০ দশমিক ৯ মিটার ও ১৬ দশমিক ১৩ মিটার ( ৬র্৯ ও ৪র্০)। মসজিদের প্রাচীর ২ দশমিক ৭২ মিটার (দশমিক ৫ ফুট) প্রশস্ত বা দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট, প্রস্থ ৩২ ফুট এবং উচ্চতা ৪৪ ফুট । মসজিদের চার কোণায় রয়েছে ৪টি বিশাল আকারের অষ্টকোণাকৃতির স্তম্ভ বা মিনার। স্ফীত রেখার সাহায্যে অলঙ্কৃত মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপরে উঠে গেছে। চূড়ায় রয়েছে কারুকার্যময় সুন্দর ছোট ছোট গম্বুজ। গম্বুজগুলোর গায়ে বিভিন্ন রকমের কারুকার্য মসজিদটির সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। মসজিদটির প্রধান কক্ষ ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদটির পূর্ব ও মাঝের দেয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে দুটি করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে আছে ৩টি সুন্দর মেহরাব। প্রধান কক্ষের প্রতিটি দেয়ালের সঙ্গে দুটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ আছে। প্রধান কক্ষটি বর্গাকৃতির এবং ভেতরের দিকে এর প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৫৭ মিটার। প্রধান কক্ষের ওপরে রয়েছে একটি বিশাল মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ। মাঝখানের প্রবেশপথের ওপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি রয়েছে এর আগেও এখানে একটি শিলালিপি ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এই শিলালিপিটি ফার্সিতে লেখা। কোনো কারণে আদি শিলালিপিটি বিনষ্ট হলে পরবর্তী সময়ে মসজিদ মেরামতে বর্তমান শিলালিপিটি লাগানো হয়। বর্তমানে এ শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে আতিয়া মসজিদটি নির্মাণ হয় ১০১৮ হিজরিতে। জানা যায়, ১৬০৯ সালে বায়েজিদ খান পন্নীর পুত্র সাঈদ খান পন্নী মসজিদটি নির্মাণ করেন। টাঙ্গাইলের করটিয়ার বিখ্যাত পন্নী জমিদার বংশের আদি পুরুষ হলেন সাঈদ খান পন্নী। মসজিদের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ফটকের ডানদিকে আরেকটি শিলালিপি আছে। ইংরেজিতে লেখা এই শিলালিপি পাঠে জানা যায়, ১৬০৯ সালে সাঈদ খান পন্নী এটি নির্মাণ করেন। এরপর ১৮৩৭ সালে মসজিদটি সংস্কার করেন দেলদুয়ার জমিদার বাড়ির সদস্য রওশন খাতুন চৌধুরানী। পরে দেলদুয়ারের জমিদার আবু আহম্মদ গজনবী ও করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীসহ কজন মিলে ১৯০৯ সালে পুনরায় মসজিদটি সংস্কার করেন। বর্তমানে জাতীয় জাদুঘর এটির তত্ত্বাবধায়ক। টাঙ্গাইলের আতিয়া জামিয়া মসজিদটি দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। তবে মসজিদের দেয়ালের ওপর যে চিত্রফলক ছিল তা বহুলাংশে নষ্ট হয়েছে। মসজিদটি কতটা কারুকার্যময় ছিল তা বোঝা যায় এর নির্মাণশৈলী ও চিত্রফলক দেখে। এটি বাংলাদেশের অন্যান্য মসজিদ থেকে একটু ভিন্ন। মসজিদের প্রায় লাগোয়া পশ্চিম দিকেই রয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের অতি প্রাচীন একটি পুকুর। এটি উত্তর-দক্ষিণে মাঝারি আকারের মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। আতিয়া জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার স্থানজুড়ে বহু প্রাচীন কীর্তি ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন রয়েছে। মোগল আমলে এটি ছিল প্রশাসনিক কেন্দ্র। প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ-সুলতানী আমল ও ইংরেজ আমলের প্রথম দিকেও এ স্থানের প্রাধান্য ছিল। মসজিদের খতিব মাওলানা ফরিদ আহম্মেদ জানান, ২০০১ সালের পর থেকে কোনো চুনকাম করা হয়নি। অযতœ-অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে দেশের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন ৪০০ বছরের পুরনো আটিয়া জামে মসজিদটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এখনো মসজিদটি দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় করে। এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীরা মসজিদটির সংস্কার ও পুনরায় যেকোনো টাকার নোটে প্রচ্ছদ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়