সিলেট: সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীতা নিয়ে সিলেট চরম বিরোধ চলছে বিএনপিতে। নির্বাচনে বিএনপির চারজন মেয়র প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এ নিয়ে সিলেট বিএনপির নেতাকর্মীরা চরম ক্ষুব্ধ।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, তারা আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে কাজ করবেন না। তাই আসন্ন নির্বাচন কিভাবে সামলাবেন এ নিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী তীব্র সংকটে রয়েছেন।
মহানগর বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সিলেটে ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের নাম ভাঙিয়ে অনেক স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের নজির গড়েন। তখন সিলেটবাসী আরিফুল হক চৌধুরীকে ‘ছায়ামন্ত্রী’ মনে করতেন।
সিলেটের সব উন্নয়ন কাজ এবং প্রশাসন তখন চলতো তারই ইশারায়। নেতাদের অভিযোগ, সিলেটের স্কুল-কলেজ, শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সব উন্নয়ন প্রকল্পের তিনি প্রধান ছিলেন। সব অনুষ্ঠানে সভাপতি থাকতেন আরিফুল হক চৌধুরী। অত্যন্ত সুকৌশলে তিনি অর্থমন্ত্রীকে নিজের কব্জায় রেখেছিলেন।
আরিফুল হক চৌধুরীর মাধ্যমে না গেলে অর্থমন্ত্রী সিলেট বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গে দেখা করতেন না। এ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা আরিফের ওপর ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। কিন্তু মুখ ফুটে তারা কিছু বলতে পারতেন না।
নগরীর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ তিনি তার পছন্দের লোকদের দিয়েছিলেন। ত্যাগী নেতাকর্মীদের তিনি কখনো পৃষ্ঠপোষকতা করেননি। তাই এক পর্যায়ে তার কাছের লোক বলে পরিচিত মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা এক এক করে তার কাছ থেকে দূরে চলে যান। যতোদিন ক্ষমতায় ছিলেন ততোদিন তিনি সিলেটে ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর।
মহানগর নেতারা বলছেন, জোট সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই আরিফুল হক চৌধুরী সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। তখন তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়। মামলাগুলো চালু থাকলেও এখন সেগুলো নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে ছাড়া পেয়ে তিনি এলাকায় ফিরে আসেন। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মী এবং নগরবাসীর কাছ থেকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে চলে যান। আসন্ন মেয়র নির্বাচনে তা প্রকাশ্যে আসে।
বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হন। তার বিরুদ্ধে বিএনপির অপর তিন নেতা মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি নাসিম হোসাইন, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সামছুজ্জামান জামান এবং মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকী মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
এ নিয়ে সিলেট বিএনপিতে সৃষ্টি হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। মহানগর বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ‘দুর্নীতিবাজ’ আরিফুল হক চৌধুরীকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে চাই না। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়া হলে তাদের আপত্তি থাকবে না বলে তারা প্রকাশ্য ঘোষণা দেন।
এ অবস্থায় বিরোধ মেটাতে গত ২০ মে সিলেট আসেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি চার প্রার্থীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। কিন্তু বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি ২২ মে দুপুরে ঢাকা চলে যান।
সিলেট ত্যাগের আগে তিনি মেয়র প্রার্থীতা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কথা খালেদা জিয়াকে অবগত করেন। এরপর খালেদা জিয়া চার প্রার্থীকে ঢাকায় ডেকে পাঠান।
২৩ মে রাত ৮টায় সিলেটের চার মেয়র প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসে যান। সেখানে যাওয়ার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাখাওয়াত হাসান জীবন চার মেয়র প্রার্থীকে নিয়ে বৈঠক করেন।
কিন্তু বৈঠকে তারা কোনো সমাধানে আসতে পারেননি। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিএনপি নেতারা আরিফুল হক চৌধুরীকে মেয়র প্রার্থী করা হবে বলে অপর তিন প্রার্থীকে জানান। তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। কিন্তু তিন প্রার্থীই তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে তিন প্রার্থীর অনড় অবস্থানের কথা খালেদা জিয়াকে জানান বিএনপি নেতারা।
এরপর খালেদা জিয়া চার প্রার্থীকে তার কক্ষে ডাকেন। খালেদা জিয়া তাদের কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলেন, ‘আমরা আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা এলাকায় ফিরে যাও এবং একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করো।’
মনোনয়ন না পাওয়া তিন মেয়র প্রার্থী খালেদা জিয়ার কাছে আরিফুল হক চৌধুরীর দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ তুলে ধরেন। মেয়র প্রার্থীদের এসব অভিযোগের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে এসব দুর্নীতির অভিযোগের কথা সবই জানি। আমি তাকে বলে দিয়েছি- আগামীতে তিনি কোনো খারাপ কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’
এরপর মেয়র প্রার্থীরা খালেদা জিয়ার কক্ষ ত্যাগ করেন। চার প্রার্থী সিলেট ফিরে আসেন।
এদিকে আরিফুল হক চৌধুরীকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়ায় মনোনয়ন না পাওয়া তিন মেয়র প্রার্থী এবং সিলেট বিএনপির নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। মহানগর বিএনপির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা জানান, তারা আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে কাজ করবেন না।
তারা জানান, যেহেতু চেয়ারপারসন আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছেন, তাই দলীয় স্বার্থের দিকটি বিবেচনা করে আমরা প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবো না। হাইকমান্ডের নির্দেশে আমরা হয়তো আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচারণায় লোক দেখানোর জন্য অংশ নেবো।
কিন্তু মনে-প্রাণে আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে তারা কাজ করবেন না বলে জানান বিএনপি নেতারা।
মহানগর বিএনপির নেতারা আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় আসন্ন নির্বাচনে তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। নির্বাচনী বৈতরণী তিনি কিভাবে পার হবেন তা নিয়ে তাকে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন, ‘যারা তার বিরুদ্ধাচরণ করছেন তারা বিএনপির কেউ নন।’
কিন্তু সিলেট বিএনপিতে আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তাদেরও সিলেটে জনসমর্থন এবং সমর্থকও রয়েছে। তাই এসব বিরোধী গ্রুপকে তার পক্ষে আনতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আরিফুলকে। শেষ পর্যন্ত আরিফুল হক চৌধুরী বিরোধী গ্রুপকে তার পক্ষে আনতে পারবেন কি না সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
(খলিলুর রহমান,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলামেইল২৪ডটকম)
খবর বিভাগঃ
সর্বশেষ সংবাদ
সারাদেশ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়