Sunday, May 26

নজরুল কেন জাতীয় কবি?

মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ নজরুল 
কেন জাতীয় কবি? এরকম একটি প্রশ্ন অনেকের মনেই রয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্নটি লিখিত এবং অলিখিতভাবে, উচ্চারণও করেন। নজরুল কেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি? এমন প্রশ্নের অস্তিত্বও রয়েছে অনেকের মনে, কেউ কেউ লিখিত এবং অলিখিতভাবে প্রশ্নটি উচ্চারণ ও উপস্থাপন করেছেন। এসব প্রশ্ন নিয়ে অনেকে বিতর্কেও জড়িয়েছেন। নজরুল কেন জাতীয় কবি? কিংবা, নজরুল কেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ‘জাতীয় কবি’ কে হতে পারেন, জাতীয় কবি কাকে বলা যায়, জাতীয় কবি ও তাঁর কাব্যে চারিত্র্যধর্ম কি, সে সম্পর্কেই আলোচনা করতে হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কে হতে পারেন, কার সেই অধিকার ও দাবী রয়েছে, কার কাব্যের চারিত্র্যধর্ম সে দাবী ও অধিকারের অনুকূলে, সে সম্পর্কেও আলোকপাত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে, জাতীয় কবি তিনিই হতে পারেন যার কাব্যে জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা, সংগ্রাম-সাধনা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং সামগ্রিক আত্মপরিচয় বিধৃত। জাতীয় কবি তিনিই হতে পারেন যার কাব্য শুধু জাতীয় সাহিত্যের ভান্ডারই সমৃ্দ্ধ এবং ঐশ্বর্যমন্ডিত করে না, জাতীয় ভাষাই সমৃদ্ধ করে না, দেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতি এবং দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন কল্পনা, সংগ্রাম সাধনার রূপায়ণ ঘটায় ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য নির্বিশেষে সবার পরিচয় বিধৃত করে। জাতীয় কবি তিনিই হতে পারেন যার কাব্য সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্বশীল। জাতীয় কবির কাব্যের প্রকৃতি ও চারিত্র্যধর্ম সম্পর্কে হয়তো আরও অনেক সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা বি&&শ্লষণ দেয়া যেতে পারে। তবে সংক্ষেপে এ কথা বলতেই হবে যে, যে কবির রচনায় ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশ ও জাতির অন্তর্গত সর্বশ্রেণীর মানুষের আত্মপরিচয় ও আশা আকাঙ্ক্ষার, সংগ্রাম-সাধনার প্রতিফলন এবং বলিষ্ঠ রূপায়ণ নেই, তিনি জাতীয় সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ রূপকার হয়তো হতে পারেন, কিন্তু জাতীয় কবি হতে পারেন না। এই প্রেক্ষিতে ‘জাতি’ এবং ‘জাতীয়-সাহিত্য’ ইত্যাদি সম্পর্কেও আলোকপাত করতে হয়, জাতি এবং জাতীয় সাহিত্য কাকে বলা যায়, জাতি ও জাতীয় সাহিত্যের সংজ্ঞা ও চারিত্র্যধর্ম কি, সে বিষয়েও আলোকপাত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। ‘জাতি’ কাকে বলে, কি উপাদানে জাতি গঠিত হয়, জাতির সংজ্ঞা কি- এ নিয়ে নানা মতভেদ আছে, ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণেরও অন্ত নেই। তবুও সংক্ষেপে বলা যায়, ভৌগলিক এলাকা, দেশ রাষ্ট্র, ধর্ম, ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদিই জাতি গঠনের উপাদান হিসাবে কাজ করে, এসবের এক বা একাধিক উপাদানকে কেন্দ্র ও অবলম্বন করেও জাতি গঠিত হতে পারে। মোটামুটিভাবে একথা বলা চলে যে সমাজবদ্ধ মানুষের এক বা একাধিক জাতিরূপে গড়ে উঠার কিংবা কোনো বিশিষ্ট জাতিগঠনের মূলে অনেক উপাদানই কাজ করে, বহুকালের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারা, বংশ, ধর্ম, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐক্য এবং একই ঐতিহাসিক বিকাশ জাতিগঠনে বিশেষরূপে সহায়তা করে। তবুও অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, জাতি গঠনের আসল উপাদান হচ্ছে একটি সেন্টিমেন্ট এবং একটি অনুপ্রেরণা। আর এই সেন্টিমেন্ট হচ্ছে সাম্যবোধের এবং অনুপ্রেরণা হচ্ছে একই জনসমষ্টির অধিকারী হওয়ার প্রবণতা। বস্ত্তত: মানুষের জাতীয়তাবোধের পেছনে একসঙ্গে বাস করার অনুভূতি, আবেগ ও ইচ্ছা কার্যকর, যাকে বলা যেতে পারে পারিবারিক অনুভূতিরই পরিশোধিত ব্যাপ্তি। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, এই ধরনের অনুভূতি থাকলে একটি জাতিকে একটি রাষ্ট্রে সংগঠিত করা সহজ। বস্ত্তত: জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার এবং জাতি গঠনের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে কোনটি কখন প্রাধান্য পাবে এবং একসঙ্গে বাস করার অনুভূতি, আবেগ ও ইচ্ছা জাগিয়ে তুলবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই নির্ভর করে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর। জাতি গঠনের উপাদান, অবলম্বন ও কার্যকারণ সম্পর্কে এখানে যে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো, তার আলোকে এবং প্রেক্ষিতে দেখলে, ভারতীয় জাতি, বাঙালি জাতি, হিন্দু জাতি, মুসলিম জাতি ইত্যাকার জাতি এবং ভারতীয় জাতীয়তা, বাঙালি জাতীয়তা, হিন্দু জাতীয়তা, মুসলিম জাতীয়তা ইত্যাকার জাতীয়তার উদ্ভব, বিকাশ, বিবর্তন এবং কার্যকারণের সূত্র সন্ধান মিলবে। এবং কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য কেন বিভিন্ন সময়ে জাতীয় আত্মপরিচয়, জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন কল্পনা, সংগ্রাম সাধনার ধারক বাহক হতে পেরেছে। তিনি কেন বৃটিশ যুগেই জাতীয় কবির অভিধায় চিহ্নিত হয়েছেন, কেন তিনি জাতীয় কবির দাবীদার হতে পারেন, তার যথার্থতাও উপলব্ধি করা যাবে। প্রথমে বৃটিশ যুগের অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের পটভূমি এবং প্রেক্ষাপটের কথাই ধরা যাক। অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের পটভূমিতে ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় বিচারে ভারতের অধিবাসী মাত্রই ভারতীয় এবং ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদির বিস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও, সবাই ভারতীয় জাতীয়তার অন্তর্গত এই ছিল তখনকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় জনসম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবীদের দাবী। যদিও ধর্ম, ভাষা, সমাজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের বিচারে ভারতের অধিবাসীরা এক ও অভিন্ন জাতি নয়, ভারতে বহু জাতি গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বাস একথাও বাস্তবতার আলোকে এবং যুক্তি-তর্কের সাথেই উচ্চারিত হয়েছে। তবুও অবিভক্ত উপমহাদেশ তথা বৃটিশ ভারত এক দেশ ও এক জাতি এই বক্তব্য এবং সংজ্ঞা সূত্র মেনে নিলেও দেখা যায় যে, কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে রয়েছে ভারতীয় জাতীয়তার বলিষ্ঠ ও বিচিত্র প্রতিফলন, উপমহাদেশ তথা অবিভক্ত ভারতের সমগ্র জনমন্ডলীর আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন কল্পনা ও সংগ্রাম সাধনা তাতে বাঙ্ময়, ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামী প্রেরণায় তা উজ্জীবিত। অবিভক্ত ভারতে জাতীয় জাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অগ্রনায়ক কাজী নজরুল ইসলাম তার কাব্যে যেমন ভারতীয় পটভূমিতে স্বদেশ প্রেম, স্বজাতি প্রীতি ও জাতীয়তাবোধ বাঙ্ময় করে তুলেছেন, তেমনি বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়ে কারাবন্দীও হয়েছেন, জেলে গিয়েও তিনি রচনা করেছেন শিকল ভাঙার গান। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়, ভাষা-সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক এলাকার অধিবাসী নিয়ে গঠিত যে ভারতীয় মহাজাতি তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা-সংগ্রাম সাধনার রূপকার হিসাবে দেখলেও নজরুল কেন জাতীয় কবি, এ সত্য উপলব্ধি করা যাবে। বর্তমান আলোচনার গোড়াতেই উল্লেখিত হয়েছে যে, জাতি ও জাতীয়তা বিভিন্ন পর্যায়ে নানা উপাদানে গঠিত হয়, এবং তাতেও বিবর্তনের স্পর্শ লাগে, জাতি ও জাতীয়তা সর্বদা ও সর্বথা এক ও অভিন্ন থাকে না। অবিভক্ত উপমহাদেশে এবং সেই বৃটিশ যুগে ভারতীয় জাতীয়তার পরিপোষক থাকলেও কাজী নজরুল ইসলামও এ সত্য জানতেন এবং মানতেন। সেই কারণেই অভিন্ন ভারতীয় জাতীয়তার প্রবক্তা হলেও, সেকালেই তিনি বাঙালি জাতীয়তা এবং হিন্দু-মুসলিম জাতীয়তা সম্পর্কেও ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। জাতিগঠনে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাতন্ত্র্য যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বড় ভূমিকা পালন করে, সে সম্পর্কেও নজরুলর চেতনা ছিল অত্যন্ত গভীর। এ কারণেই নজরুল ভারতীয় জাতীয়তা ও জাগরণের গান গেয়েছেন আবার তারই ক&&ন্ঠ উচ্চারিত হয়েছে; মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান / মুসলিম তার নয়নমণি / হিন্দু তাহার প্রাণ।’ ধর্ম যে জাতি গঠন ও জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির এক বড় উৎস ও প্রেরণা, এ সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন বলেই ভারতীয় জাতীয়তা এবং হিন্দু মুসলিম মিলনের এক বড় প্রবক্তা হয়েও নজরুল প্যান ইসলামিজমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন: ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি।’ বৃটিশ যুগে ভারতীয় জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নজরুল হিন্দু মুসলমান সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, সে কথা অবিভক্ত বাংলায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতেও সত্য ছিল এবং সে কারণে বৃটিশ যুগে অবিভক্ত বাংলার পটভূমিতেও হোক, আর বাঙলার পটভূমিতে এক বৃন্তে দু’টি কুসুম ‘হিন্দু-মুসলমান’ সম্পর্কে এবং তাদের মিলন, ঐক্য ও সম্প্রীতি বিষয়ে অনেক অনুপ্রেরণাদায়ক কবিতা গান রচনা করেছেন। বলাবাহল্য, ভারতীয় পটভূমিতে হোক, আর বাংলার পটভূমিতেই হোক, নজরুল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, মিলন এবং সম্প্রীতি কামনা করলেও, তারা যে ভৌগোলিক ও দেশীয় পটভূমিতে এক বৃন্তে দু’টি কুসুম’ এবং এক বৃন্তে একটি বা অভিন্ন কুসুম নয়, এ সত্য বিস্মৃত হননি। অর্থাৎ জাতি এবং জাতীয়তার বিচারে ফেডারেশনই (ফিউশন নয়) ছিল নজরুলের কাম্য। নজরুল ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের তথা সমগ্র জনমন্ডলীর জাগরণ ও নব উত্থান কামনা করেছেন, তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন কল্পনা ও সংগ্রাম সাধনার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। এ কথা যেমন অবিভক্ত ভারতের, তেমনি বাংলার পটভূমিতেও সত্য। তবুও, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের তথা সমগ্র জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার, স্বপ্ন কল্পনা ও আবেগ অনুভূতির, সংগ্রাম সাধনার রূপকার হলেও হিন্দু মুসলমান এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় ভারত ও বাংলার প্রধান দুই জনগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় আত্মপরিচয় ও জাতীয়তাবোধের ধারকদের আকাঙ্ক্ষা ও অভীপ্সাই নজরুল কাব্যে স্বতন্ত্রভাবেও ভাষা পেয়েছে। এ কারণেই, হিন্দু-মুসলিম মিলিত জাতীয়তার দিক থেকেই হোক, যে ভাবেই দেখা হোক না কেন, জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন কল্পনা, আবেগ অনুভূতি ও সংগ্রাম সাধনার রূপকার হিসাবে নজরুল জাতীয় কবির দাবীদার থেকেই যান। ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত আত্মপরিচয়ের নিরিখে না দেখে যদি কেবল সম্প্রদায় নিরপেক্ষ এবং আর্থ সামাজিক ও শ্রেণীগত অবস্থান থেকেও দেখা হয় তাহলেও এ সত্য স্বীকার করতে হবে যে, জাতীয় কবি তিনিই হতে পারেন যার কাব্যে দেশ ও জাতির জনমন্ডলীর অন্তর্গত সাধারণ মানুষ, সব পেশাজীবী জনগণ তথা কৃষক, শ্রমিক, জেলে, কুলি মজুর নির্বিশেষে সবার শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের জীবন ও যন্ত্রণা এবং আশা আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম সাধনা ভাষা পায়। নজরুল কাব্যে এ ব্যাপারটি যে অত্যন্ত ব্যাপক ও বলিষ্ঠভাবে ঘটেছে, তিনি যে দেশ জাতির অন্তর্গত অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের আবেগ অনুভূতি, সুখ দুঃখ, আশা- আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন কল্পনাই তাদের রচনায় প্রতিফলিত হয়, সর্বজনীন আবেদনের অধিকার অর্জন করে। কিন্তু কবিও কোনো না কোনো দেশ ও সমাজ সীমার বাসিন্দা এবং ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতির অন্তর্গত। সে-কারণেই তার কাব্যেও স্বদেশ স্বজাতি এবং স্বদেশের মানুষের আলেখ্য বিধৃত হয়, তাদের আশা- আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-দুঃখ ভাষা পায়। নজরুলের কাব্যে প্রধানত: স্বদেশ ও স্বজাতির এবং স্বদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত বঞ্চিত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন কল্পনা ও সংগ্রাম সাধনার কথা ভাষা পেয়েছে এবং দেশ, সম্প্রদায় ও জাতি নিরপেক্ষ বিশ্বজনীন মানুষের অভীপ্সা ও রূপায়িত হয়েছে। উল্লেখ্য, জাতীয় কবি তিনিই হতে পারেন, যিনি আন্তর্জাতিকতা বা বিশ্বজনীনতার ব্যাপারটাকে অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা করেন না, কিন্তু দেশীয় ও জাতীয় ব্যাপারকে স্বদেশ ও স্বজাতির মানুষকে বড় করে দেখেন। নজরুল কেন জাতীয় কবি বর্ণিত নিরিখে বিচার করে দেখলেও তার উত্তর মিলবে। জাতীয় কবি শুধু দেশীয় ও জাতীয় ভাষায় তথা মাতৃভাষায় কাব্যরচনা করেই তার দায়িত্ব শেষ করেন না তিনি তার কাব্য সাধনার মাধ্যমে ভাষাকে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যমন্ডিত করেন, দেশ ও জাতির অন্তর্গত জনমন্ডলীর তথা সাধারণ মানুষের ভাষাও তার রচনায় স্থান দেন, জনজীবনে প্রচলিত ঘরোয়া জবান তথা শব্দাবলী, বাকভঙ্গী, ইডিয়ম ইত্যাদিও গ্রহণ করে ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন, জনজীবনের সঙ্গে সেতুবন্ধনও রচনা করেন। স্বদেশ ও স্বজাতির অন্তর্গত সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে, দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যধারার সঙ্গে এবং বিশেষভাবে হিন্দু-মুসলিম এই দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পারিবারিক ও সামাজিক ভাষার বিশেষত: ঘরোয়া জবানের পার্থক্যের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের ছিল ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। সমগ্র জাতীয় জীবন এবং জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছিলেন বলেই নজরুল তার কাব্যে হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আশা- আকাঙ্ক্ষা ও ইতিহাস ঐতিহ্যে যেমন রূপায়ণ ঘটিয়েছেন, তেমনি তাঁর কাব্যের ভাষায় অবলীলায় ব্যবহার করেছেন উভয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের প্রচলিত ভাষার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। নজরুল কবিতায় শুধু সূক্ষ্মচেতনা এবং সৌন্দর্যের সাধনাই করেননি, সাধারণ মানুষের বিচিত্র সমস্যা, সুখ-দুঃখ বেদনাবোধ এবং সংগ্রাম সাধনাকেও তিনি কাব্যের উপজীব্য করে নিয়েছেন, এবং বিষয়ের তাগিদেই নজরুলকে অনেকখানি প্রচলিত ভাষা-ঘরোয়া জবান ব্যবহার করতে হয়েছে, হাত পাততে হয়েছে হিন্দু মুসলিম উভয় ঐতিহ্যের ভান্ডারে। নজরুলের আবির্ভাবে শুধু বাংলা কাব্যে উপজীব্যেরই পরিবর্তন ও সম্প্রসারণ ঘটেনি, ভাষারও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, সংস্কৃত ও হিন্দু ঐতিহ্যমন্ডিত শব্দাবলী ও ভাষার পাশাপাশি এবং স্বতন্ত্রভাবেও বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্যমন্ডিত আরবী ফারসী শব্দাবলী ও ভাষা ব্যাপকভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করে নিয়েছে। এই বাস্তবতার আলোকে দেখলেও নজরুল কেন জাতীয় কবি-এই সত্যের সূত্র সন্ধান মিলবে। (অসমাপ্ত)

(সিলেটের ডাক)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়