Wednesday, January 9

:: ২৬ হাজার ১৯৩ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা ::

শিক্ষার মানোন্নয়ন ও প্রসারে তার সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শিক্ষাকে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। শিক্ষার উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। বাজেটে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রথমবারের মতো সার্বজনীন শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করে ইতোমধ্যেই তার বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা উপলক্ষে প্রাথমিক শিক্ষক মহাসমাবেশে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। উৎসবমুখর পরিবেশে অর্ধ লক্ষাধিক প্রাথমিক শিক্ষকের এ মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। শিক্ষার উন্নয়নে এভাবে আজীবন কাজ করে যাওয়ারও দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শিক্ষার উন্নতি হয়। আওয়ামী লীগ শিক্ষা ও শিক্ষকদের সন্মান-মর্যাদা দেয়। পক্ষান্তরে বিএনপি চায় না, এদেশের মানুষ শিক্ষিত হোক। তাই তারা ক্ষমতায় এসে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করেনি। শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয় করেন বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাহলে ৪০ বছর পরে আমরা কেন পারবো না? তাই নিজেদের অর্থেই এবার চাকরি জাতীয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হলো।



এটি প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ উল্লেখ করে ধাপে ধাপে জাতীয়করণ করার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ প্রক্রিয়া আমাদের সময়েই হবে। আমরা আবার ক্ষমতায় আসবো বলেও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা চেয়েছিলেন শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ। আমরা যে শুধু এমপিওভুক্ত রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করছি, তা নয়। আমরা স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিওবহির্ভুত কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এনজিও বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত বিদ্যালয় এবং স্থাপিত কিন্তু চালুর অনুমতির অপেক্ষাধীন বিদ্যালয়গুলোও সরকারি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।



প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, স্থায়ী/অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের নয় হাজার ২৫ জন শিক্ষককে ১ জুলাই থেকে এবং পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষায় থাকা ৯৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষককে তৃতীয় ধাপে আগামী বছর ১ জুলাই জাতীয়করণের আওতায় আনা হবে। তিনি আগামীতে সরকারিভাবেই নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে বলেন, কোথাও কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হলে সরকারই তা করবে। যেগুলো বেসরকারি রয়েছে সেগুলা থাকবে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাঁধ্যতামূলক ও জাতীয়করণ করেছে। তাই আগামীতে আর প্রাথমিক বিদ্যালয় বেসরকারিভাবে করার প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার মানোন্নয়নে আরো বেশি দায়িত্ব ও ভূমিকা পালনেরও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ভোর থেকেই সারাদেশ থেকে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকরা সমবেত হন প্যারেড গ্রাউন্ডে। আর দেশের গ্রাম, উপজেলা, জেলা থেকে বাসের বহর নিয়ে রাজধানীতে তাদের আসা শুরু হয় মঙ্গলবার রাত থেকেই।



প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ঘোষণার মাধ্যমে অবহেলিত ও বেতন-ভাতা বঞ্চিত লক্ষাধিক প্রাথমিক শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা ও আন্দোলন-সংগ্রামের অবসান ঘটলো। প্রায় ২১ বছর ধরে এ দাবিতে আন্দোলন করার পর তাদের দাবি পূরণ হলো। এ কারণে ঢাকার মহাসমাবেশে আসা শিক্ষকদের চোখে-মুখে দেখা গেছে খুশি-আনন্দ আর বিজয় উল্লাস। বহু প্রতীক্ষার পর এ দিনটি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বড়াইগ্রাম রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহিত রঞ্জন পাল। তিনি বলেন, ১৪ বছর ধরে চাকরি করছি। এ দিনটির প্রতীক্ষা ছিলো অনেক দিন ধরে। অবশেষে আমাদের দাবি আদায় হয়েছে। খুলনার পশুরহাট বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌতম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ দিনটির জন্য সংগ্রাম করে আসছিলাম। আমাদের দাবি আদায় হয়েছে ভাবতেই ভালো লাগছে। এমন কথা এখানে উপস্থিত সব শিক্ষকদের। এ উৎসবমুখর পরিবেশে কুদ্দুস বয়াতি বাড়তি আনন্দ দেন তার গানের মাধ্যমে। তিন ধাপে দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষক সরকারি সুযোগ-সুবিধা সুযোগ পাবেন।



এর মধ্যে প্রথম ধাপে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকেই ২২ হাজার ৯৮১টি বিদ্যালয়ের ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষক সরকারি সুযোগ-সুবিধাভুক্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয় ধাপে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে স্থায়ী ও অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি স্কুলের নয় হাজার ২৫ জন শিক্ষক সুবিধা পাবেন। তৃতীয় ধাপে ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষাধীন ৯৬০টি স্কুলের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষক এমপিও সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবেন। প্রথম ধাপে ২০১২-১৩ অর্থবছরে অতিরিক্ত খরচ হবে একশ' কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জাতীয়করণের জন্য অতিরিক্ত ৩৭১ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ধাপ বাস্তবায়নে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত খরচ হবে ৬৫১ কোটি টাকা। এতো বিশাল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক সমাজের দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ হবে। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বৈষম্য ছিল। বেসরকারি বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটাও দূর হয়ে যাবে।



উল্লেখ্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন। ফলে সে সময় এসব বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩ জন শিক্ষককের চাকরি সরকারি হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরো এক হাজার ৫০৭টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। এদিকে এই জাতীয়করণের ঘোষণার পর শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের সুরাহা হচ্ছে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে ১৯৯১ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করেন। এ দাবিতে ১৯৯৭ সালে ঢাকার ওসমানী উদ্যানে শিক্ষকরা আমরণ অনশন করেন। শিক্ষকদের কর্মসূচির নবম দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদের অনশন ভাঙান।



পরবর্তীতে ২০০০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ওসমানী উদ্যানে শিক্ষকরা শিক্ষক মহাসমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের দাবি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তর ঘোষণা দেন। এর পরে শিক্ষকদের আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়করণে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ খবরে শিক্ষকদের মধ্যে অসেন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ওই বছরের ২১ থেকে ২৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক। এতেও দাবি আদায় না হওয়ার গত বছরের ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ধর্মঘট পালন করেন তারা। দাবি আদায়ে ১৭-১৯ জানুয়ারি কর্মবিরতিও পালন করেন শিক্ষকরা।(ফেয়ার নিউজ)



এরপরেও সরকার তাদের অবস্থানে অনড় থাকলে শিক্ষকরা গত বছরের ১৩ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমূখে পদযাত্রা, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এসব কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের পুটিনিতে আহত এক শিক্ষক মারা যান। শিক্ষকদের আন্দোলন অব্যহত থাকলে ২০১২ সালের ১৬ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীনের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করেও আরো দুই দিন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা।২০১২ সালের ১৮ মে শিক্ষরা ৩১ মের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের বৈঠকের সময় বেধে দেন। এ সময়ের মধ্যে ঘোষণা না এলে একই বছরের ১৬ জুন থেকে দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনিদির্ষ্টকালের জন্য তালা ঝোলানোর হুমকি দেন তারা। পরবর্তীতে গত বছরের ২৭ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বাস দেন, শিগগিরই শিক্ষক মহাসমাবেশ থেকে বেসরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের জাতীয়করণের ঘোষণা দেওয়া হবে।






শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়