যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে রাজধীনীতে মহান বিজয় দিবস উৎযাপিত হয়েছে। রোববার ছিল বিজয় দিবসের ৪১তম বার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিকেলে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) হানাদার পাকিস্তানী সেনারা মাথা নিচু করে যৌথ কমান্ডের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। যে অস্ত্র দিয়ে তারা দীর্ঘ নয় মাস বাঙালির রক্ত ঝরিয়েছে, ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, দু�লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে সেই অস্ত্র পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে এক রাশ হতাশা এবং অপমানের গ্লানি নিয়ে দূরন্ত বাঙালির কাছে পরাজয় মেনে নেয়। সেই থেকে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। বাঙালির শৌর্যবীর্য এবং বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সকালে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তলন, শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতীকৃতীতে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিজয় র্যালি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাতীয় জীবনে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির পালন করা হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়ে সবার দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ এবং জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। জাতি আর এ কলঙ্ক বহন করতে চায়না। শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ এবং বাংলার মাটিকে কলঙ্কমুক্ত করতে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে হবে। ভোর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কূটনীতিকগণসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। জাতি গঠনে স্বাধীনতার চেতনা পুনরুজ্জীবিত করতে দিবসটি সরকারিভাবে উদযাপনের বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে একত্রিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির কর্মসূচির সূচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভোর ৬ টা ৪৫ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর প্রধানমন্ত্রী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায়। এ সময় বিউগলে করুন সুর বেজে উঠে। পরে দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দলের পক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে আরেকটি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাখা পরিদর্শক বইতে স্বাক্ষর করেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে রাজধানীতে ফিরে প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতীকৃতীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং পরে আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর শেখ হাসিনা মহান নেতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কিছুক্ষণ সেখানেও নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই মহান নেতার নেতৃত্বে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশ স্বাধীন হয়। এ সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংদস উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এডভোকেট আফজাল হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু ভবন ত্যাগ করার পরে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থানটি সর্ব সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এ সময়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তর ও দক্ষিণ, ছাত্রলীগ উত্তর ও দক্ষিণের নেতা ও কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর প্রতীকৃতীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দরস্থ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিএনসিসি, বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড, কারারক্ষী এবং ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সালাম গ্রহণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। এ সময় বিমান বাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট ও এ্যারোবেটিক ডিসপ্লে� এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ দিবসটি উপলক্ষে দু�দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করেছে। দলটির উদ্যোগে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল এবং বিকেলে বিজয় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। বিজয় দিবসের আনন্দ সবার মাঝে পৌঁছে দেয়ার লক্ষে দুপুরে হাসপাতাল, জেলখানা, শিশুসদন, এতিমখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। জাতীয় জীবনে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হয়। এ উপলক্ষে রাজধানীকে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। নগরীর বিভিন্ন সরকারি ভবন ও স্থাপনা, সড়ক এবং সড়কদ্বীপগুলো জাতীয় পতাকাসহ রং-বেরংয়ের পতাকায় সাজানো হয়। বিভিন্ন বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিবসটি ছিল সরকারি ছুটির দিন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত এবং সরকারি ও বেসরকারি বেতার ও টিভি চ্যানেলে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হয়। দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ এবং সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রমের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার পর সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদীতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এ সময় তার সঙ্গে দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। পরে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল ফটক।
সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পর থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে আওয়ামী লীগ-এর সহযোগী সংগঠন, বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, জাতীয় পার্র্টি, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ ৭১, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, জাসদ, বাসদ, সাম্যবাদি দল, গণতন্ত্রী পার্টি, গণফোরাম, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, কৃষক সমিতি, ক্ষেত মজুর সমিতি, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, বঙ্গবন্ধু সংসদ, জাসাস, মহিলা পরিষদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্র্স ইউনিটি, সাভার প্রেসক্লাব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, জনতা ব্যাংক, বঙ্গবন্ধু পরমাণু বিজ্ঞানী পরিষদ, গণআজাদী লীগ, ইনিস্টিটিউট অব প্ল�ানার্স, কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় শ্রমিক পার্টি, এডাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভিন্ন হলসমূহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভিন্ন হলসমূহ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্র্স এসোসিয়েশন, ন্যাপ ভাষানী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল, এন সি টি বি, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন, জাকের পার্টি, নাগরিক সংহতিসহ বিভিন্ন সংগঠন পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানায় বীর শহীদদের প্রতি।ফেয়ার নিউজ

0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়