Thursday, October 13

স্মরণ





শায়খুল হাদিস আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী(রহঃ)
------মাহবুবুর রশিদ-----
আল্লাহপাক তার সৃষ্টির সেরা মাখলুক মানবজাতিকে ধ্বংসের পথ থেকে রা করে মুক্তির পথে নিয়ে আসার জন্য যুগে যুগে এমন কিছু নেককার মহামনীষী প্রেরণ করেন,যারা মানুষের জন্য নিয়ে আসেন হেদায়েতের আলো,পথ ভোলা মানুষকে দেখান জান্নাতের পথ,যাদের দ্বীনী দাওয়াত ও দোয়ার বদৌলতে পথহারা দিশেহারা মানব জাতি সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছে। এ সোনালি কাফেলার স্বর্ণপ্রদীপ অন্যতম রাহবার বহুমুখী বিরল প্রতিভার অধিকারী উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ,উস্তাদুল মুহাদ্দিসীন ও মুফাসসিরীন ফকিহুল মিল্লাত কালজয়ী বিরল ব্যক্তিত্ব আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী(রহঃ)।জন্ম ও বংশ পরিচিতঃ সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার বায়মপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম ধার্মিক পরিবারে শায়খুল হাদিস আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী(রহ:) ১৯০৭ ইংরেজীর ১৩২৭ হিজরীর মহরম মাসে পবিত্র জুমার দিনে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম ক্বারী মুহাম্মদ আব্দুল আলীম ও মাতার নাম হাফিজা সুফিয়া বেগম। উভয়েই পরহেজগার,দ্বীনদার ও মুত্তাকী ছিলেন। শিশুকালে তিনি পিতৃহারা হন ফলে মায়ের øেহ আদর্শে লালিত হন। মা হাফিজা সুফিয়া বেগম পবিত্র কুরআনে হাফিজা এবং উর্দূভাষায় শিতিা ছিলেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে মায়ের কাছ থেকে তিনি কোরআন শরীফ,উর্দূ, ও বাংলা পূর্ণভাবে আয়ত্বে আনেন। মা ছিলেন তার বাল্যকালীন উস্তাদ।বাল্য শিাঃশিশুকাল থেকে আল্লামা মুশাহিদ ছিলেন অত্যন্ত তীè মেধাবী। ৭ বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। ১০ বছর বয়সে অন্ত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিা সমাপ্ত করে তৎকালীন কানাইঘাট ইসলামীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং একই মাদ্রাসায় ৭ বছর অধ্যয়ন করেন। মাদ্রাসায় অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি কিছুদিন লালারচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিকতা করেন।উচ্চ শিার্থে বিদেশ গমনঃমাদ্রাসায় অধ্যয়ন ও চাকুরীতে বায়মপুরী হুজুরের মন ঠিকলনা। উচ্চ শিা লাভের জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিভাবে কোথায় উচ্চ শিা গ্রহণ করা যায় এ ভাবনায় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর স্কুলের চাকুরী পরিত্যাগ করে পাশ্ববর্তী ভারতে চলে যান সেখানে রামপুর আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ও একই মাদ্রাসায় ৫ বছর অধ্যয়ন করেন। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভের পর হাদীস অধ্যয়নের জন্য রামপুর থেকে সরাসরি মিরাট চলে যান। মিরাটের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও আলেম হযরত মাওলানা মশীয়তুল্লাহ সাহেবের নিকট দুই বৎসর হাদীস অধ্যয়নকালে উস্তাদের নির্দেশে কাফিয়া কিতাবের শরাহ(ব্যাখ্যা) ইজাহুল মাতালিব এবং আরো দুটি কিতাব রচনা করেন যা তার উস্তাদের নামে প্রকাশিত হয়। মিরাটে অধ্যয়ন শেষে দেশে ফিরে কানাইঘাট রহমানিয়া মাদ্রসায় প্রায় দুই বছর শিকতা করেন।দারুল উলুম দেওবন্দ গমনঃদেওবন্দের প্রতি প্রবল অনুরাগ ছিল আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরি(রহ:) এর। জ্ঞান লাভের জন্য আবারো দেশ ত্যাগ করে বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন। ১৩৫৬ হিজরীতে(১৯৩৬ ইংরেজী) তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তী হন। সেখানে তার হাদিসের শিক তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আলেম শায়খুল ইসলাম মুজ্জাদ্দিদে মিল্লাত কুতবুল আলম হযরত সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রঃ) এর ব্যক্তিগত সান্নিধ্যে থেকে প্রায় দেড় বছর লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদীসের চূড়ান্ত পরীায় মূল নম্বরের চেয়ে প্রাপ্ত নম্বর বেশী পেয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।বিভিন্ন শিা প্রতিষ্টানে অধ্যাপনাঃব্যক্তিত্ব উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবীদ সুদ আলেমেদ্বীন আল্লামা মুশাহিদ বায়মপূরী দেওবন্দ হতে দেশে ফিরে বিভিন্ন শিা প্রতিষ্টানে ইসলামের খেদমতে মনোনিবেশ করেন। তন্মধ্যে সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা,আসামের বদরপুর মাদ্রাসা,গাছবাড়ী জামেউল মাদ্রাসা,যুক্ত প্রদেশের রামপুর জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা,কানাইঘাট দারুল উলুম মাদ্রাসার নাম উল্লেখযোগ্য।রাজনৈতিক জীবনঃএকজন রাজনীতিবীদ হিসেবেও বায়মপুরী যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে আয়ূব খানের আমলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী এলাকা ছিল-জৈন্তা-গোয়াইনঘাট,কানাইঘাট-জকিগজ্ঞ,বিয়ানীবাজার। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জমিয়তের প্রার্থী হয়েও নির্বাচন করেন।অনাড়ম্বর জীবন যাপনঃআল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী নিতান্ত সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। তিনি জাকজমক পছন্দ করতেননা। তাঁর জীবনের প্রতিটি কাজ সুন্নত মোতাবেক ছিল। লুঙ্গী,লম্বাকুর্তা,সাদাটুপী ও রোমাল ছিল তার সব সময়ের পোশাক।রচনাবলীঃগ্রন্ত রচনার েেত্র আল্লামা মুশাহিদ বায়মপূরীরর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে ফতহুল করিম,আল ফুরকান,সত্যের আলো ১ম ও ২য় খন্ড,সেমাউল কুরআন,মুশকিলাতে কুরআন,ইজহারে হক,তাফসিরে লাতায়িফে রাব্বানিয়্যাহ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।কৃতিত্ব ও অবদানঃ হযরত বায়মপুরী (রহঃ) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সেমিনারে যোগদান করে শ্রেষ্ঠ আলোচক হিসেবে পুর®কৃত হয়েছেন। কৃতিত্ব ও অবদানের জন্য তার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মদনী(রহ:) তাকে যে বিশেষ সনদ বা সার্টিফিকেট দিয়েছিলন তা সংপ্তি হলেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নিচে তার বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলো।“ আমি এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সনদ প্রদান করছি যে,সিলেট জেলার অন্তর্গত কানাইঘাট নিবাসী মাওলানা মুহাম্মদ মুশাহিদ সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দ এর হাদীসে সর্বোচ্চ জামাতে(যেখানে হিন্দুস্থানের বাহিরের এবং হিন্দুস্থানের প্রত্যেক জেলার বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন ১৮০ জন ছাত্র ছিলেন তন্মধ্যে) সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করিয়াছেন। জমাতের মধ্যে প্রথম হওয়ার জন্য তাহাকে বিভিন্ন রকমের বিশেষ বিশেষ পুরষ্কার দেওয়া হইয়াছে। আল্লাহ তায়ালা তাহকে অত্যন্ত ভাল ও মহৎ জন্মগত গুনাবলী দান করেছেন। তাহার মস্তিক ও জ্ঞান শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং উজ্জ্বল,চরিত্র মহৎ ও পরিপূর্ণ। দারূল উলুম দেওবন্দে তিনি দেড় বছর ছিলেন,সেখানে তার জীবনধারা ছিল সুপবিত্র,কলুষমুক্ত এবং সর্বেেত্র প্রশংসনীয় আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যদি কোন ইসলামী শিা কেন্দ্রের শিার খেদমত সমুহ তাহার হাতে অর্পন করা হয় তাহলে তিনি প্রত্যেকটি বিভাগে অত্যন্ত দতার সঙ্গে শিা দিতে পারবেন। মুসলিম জাতির পে এই সুযোগ্য যুবক হতে খেদমত গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন এবং তার নিকট হতে কোন রকম উপকার গ্রহণ না করে তাকে নষ্ট করে দেয়া চরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। আমি দোয়া করি আল্লাহতায়ালা যেন তার ইলম ও আমলে উত্তরোত্তর উন্নতি দান করেন এবং জাতির হেদায়তের কাজে কবুল করেন। আমীন। এছাড়াও একবার আল্লামা মুশাহিদ পবিত্র হজ্বে গিয়ে দেখলেন একটি মসজিদে শাফেয়ী মাজহাবাবের একজন বড় আলেম ওয়াজ করতেছেন। অনেক বড় মজমা ছিল সেখানে বায়মপুরী ও উপস্থিত ছিলেন। ওয়াজের এক পর্যায়ে ওই আলেম হানাফী মাজহাবকে কটা করে একটা কথা বলে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে হযরত বায়মপুরী(রঃ)দাড়িয়ে আরবি ভাষায় এক ঘন্টা শুধু হানাফী ফেকাহর প্রশংসা করে ওই মাওলানার জবাব দিতে শুরু করলেন। এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে বায়মপুরী হজুরকে অনেক লোক দেখতে আসেন।ওফাতঃ১৩৯০ হিজরীর ১০ই জিলহজ্ব(১৯৭১ সালে)৬৩ বছর বয়সে পবিত্র ঈদুল আজহার রাত্রিতে তার ওফাত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, রাসুলে করীম ও প্রথম দুই খলিফা ৬৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ পুত্র,ছয় কন্যা,এক ভাই ও হাজার হাজার বন্ধু-বান্ধব,ছাত্র ও ভক্তদের শোক সাগরে ভাসিয়ে চির বিদায় গ্রহণ করেন। ঈদুল আযহার দিন লাধিক মানুষের শরীকানায় আছরের নামাযের পর তার ছোট ভাই মুজম্মিল সাহেবের ইমামতিতে জানাযার নামাজ অনুষ্টিত হয়। জানাজার পর তারই হাতে গড়া কানাইঘাট মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে তাকে সমাহিত করা হয়।মৃত্যু পরবর্তী অবস্থাঃদাফনের পর হুজুরের কবরের মাটি থেকে আতরের ঘ্রাণ বের হচ্ছে,কবরের মাটি নিয়ে অনেকের রোগ সেরেছে এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হলো মাটি নেওয়ার পালা। হযরতের কবরের মাটিতে আতরের ঘ্রাণ পাওয়া গিয়েছিল ইতিপূর্বে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল ইমাম বুখারী(রহঃ) এর মৃত্যুর পর। ইমাম বুখারীর জীবনের কিছু কিছু ঘটনার হযরতের জীবনের ঘটনাবলীর পরো ও প্রত্যে সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। যেমন (ক) কবরের মাটি নেয়া (খ) কবরের মাটি থেকে আতরের ঘ্রাণ বের হওয়া (গ) ঈদের রাত্রে ইন্তেকাল হওয়া (ঘ)৬২/৬৩ বছরে ইন্তেকাল হওয়া ইত্যাদি।

লেখকঃ সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী সদস্যঃ কানাইঘাট প্রেস কাব,কানাইঘাট,সিলেট।মোবাঃ০১৭২৭৬৬৭৭২০

থ্যসূত্রঃ ১/আল্লামা মুশাহিদ বাইয়মপুরী(র:) জীবন ও চিন্তাধারা[ অধ্যাপক মাওলানা মুবিুর রহমান সম্পাদিত}২/সিলেটের একশত একজন[ ফজলুর রহমান সম্পাদিত]

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়