দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হার্ট বা হৃদযন্ত্র। কোনো কারণে এর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলেই এহলোক থেকে পরলোকে গমন। তাই হার্টের যেকোনো রোগ থেকে সুস্থ থাকা জরুরি। এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হয়। বছর ঘুরে আবার এলো দিনটি।
আজ রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব হার্ট দিবস। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ইয়েস, ইউজ হার্ট ফর অ্যাকশন’ অর্থাৎ ‘হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে মিলে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তার মধ্যে ১৭ শতাংশরই হৃদরোগের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন তরুণের মধ্যে একজন হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছে। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টোরেল, স্থুলতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মদ্যপান, ধুমপান, মানসিক চাপ হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, সারা বিশ্বে বছরে ১৯ লাখ মানুষ তামাকের কারণে হৃদরোগে মারা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে, যা হৃদরোগকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে।
জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক। তাই সময় থাকতে হার্ট বা হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখার ছয়টি সহজ উপায় সম্পর্কে জেনে নিন। তাতেই আপনার সুস্থ থাকার পথ প্রশস্ত হবে।
খেলার ছলে ব্যায়াম
হার্ট ভালো রাখতে সপ্তাহে ন্যূনতম পাঁচ দিন করে প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়ামের প্রয়োজন বড়দের। কিন্তু ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকলে হুট করে শারীরিক কসরতের মাধ্যমে ঘাম ঝরানো ভীষণ ক্লান্তিকর ব্যাপার। এ কারণে বাসায় বাচ্চাকাচ্চা থাকলে তাদের সঙ্গে খেলার মধ্য দিয়ে ব্যায়ামের কাজটা সেরে নিতে পারেন। সেটা হতে পারে কায়িক পরিশ্রমের যেকোনো খেলা।
বাচ্চাকাচ্চা না থাকলেও সমস্যা নেই। একটু হাঁটা কিংবা সাংসারিক কাজের মধ্য দিয়ে ব্যায়ামের রুটিন সেরে নিতে পারেন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম মানে যে টানা আধঘণ্টা ব্যায়াম করতে হবে, সেটা কিন্তু নয়। এ সময়টাকে ভেঙে নিতে পারেন। সকালে ১০ মিনিট ঘাম ঝরালেন, দুপুরে অফিসে মধ্যাহ্নবিরতির সময় ১০ মিনিট হেঁটে খেতে গেলেন, অফিস থেকে ফেরার পর বিকালে কিংবা রাতে এ রকম আরও কিছু কাজ দিয়ে ব্যায়াম সেরে নিতে পারেন।
খাদ্যাভ্যাস পাল্টানো
আপনি প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত ‘স্যাচুরেটেড ফ্যাট’ (ক্ষতিসাধক স্নেহ পদার্থ) খেতে ভালোবাসেন। যেমন ধরুন, ‘রেড মিট’ কিংবা পূর্ণমাত্রায় ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি। হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে এসব খাবার ছাড়তে হবে। কিন্তু ছাড়বেন কীভাবে? আপনি তো বদভ্যাসের দাস! ভাববেন না, উপায় আছে। অভ্যাসটা ধীরে ধীরে পাল্টান। ‘রেড মিড’-এর মেন্যুতে ধীরে ধীরে ‘লো-ফ্যাট মিট’ যোগ করুন। দুগ্ধজাত খাবারের পরিবর্তে জলপাই কিংবা ‘ক্যানোলা অয়েল’ খেতে পারেন। খাবারে লবণের পরিমাণ কমান। প্রক্রিয়াজাত কিংবা প্যাকেটজাত খাবার কম খান। প্রতিদিনের খাবারে ১ হাজার ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণ খাবেন না।
ভালো করে রান্না করলে শাকসবজি খেতে কিন্তু দারুণ লাগে। শাকসবজি খান প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কাপ, সঙ্গে থাকুক ফলমূল। শস্যদানা বা ‘গ্রেইন’যুক্ত খাবার খেতে পারেন, যেমন বাদামি চাল, বার্লি, পপকর্ন, ওটমিল, গমের রুটি, গমের প্যানকেক ইত্যাদি।
বিশ্রাম নিন
দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে পরিমিত বিশ্রাম নিন। মানে, স্রেফ কিছুই করবেন না, কোনো চাপ নেওয়ার দরকার নেই। পূর্ণমাত্রায় বিশ্রাম হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী। যুক্তরাষ্ট্রের ‘একাডেমি অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়াবেটিস’-এর চিকিৎসক সুসান মুরের ভাষ্য, হৃৎপিণ্ডের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় মানসিক চাপ ‘খলনায়ক’-এর ভূমিকা পালন করে। গোটা স্বাস্থ্যের ওপরই এটা মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
তাই মাঝেমধ্যে কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ান। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করুন। সাংসারিক কিংবা অফিসের কাজ ভুলে যান। স্রেফ নিজের জন্য বিশ্রাম নিন। সেটা শুয়ে-বসে যেকোনোভাবে। বিশ্রাম নেওয়ার পর দেখবেন ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। মানে, ওই বিশ্রামের সময়টুকু আপনাকে কাজের জন্য উজ্জীবিত করে তুলবে।
ওজনকে বশ মানান
স্থূলকায় মানুষের ওজন নিয়ে দুর্ভাবনার শেষ নেই। ওজন কমাতে ক্যালরির হিসাব করছেন, ব্যায়াম করছেন কিন্তু তারপরও কমছে না কিছুতেই। একটু মাথা খাটান। আপনি কি স্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন? স্বাস্থ্যকর খাবার আর ক্যালরিযুক্ত খাবার কিন্তু এক নয়। পুষ্টিকর খাবার খান এবং ক্যালরি খরচ ও গ্রহণে ভারসাম্য আনুন। তরল খাবার খেতে পারেন। শাকসবজি থাকুক প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়।
এছাড়া শারীরিক পরিশ্রম করুন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বাধ্যতামূলক করুন। লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। বাসা থেকে বের হয়েই রিকশা না নিয়ে হেঁটে কিছুটা পথ এগোন। বাসায় ফেরার পথেও একই কৌশল অনুসরণ করুন।
ধূমপান ছাড়ার চ্যালেঞ্জ জিতুন
ধূমপানের অপকারিতা সমন্ধে আমরা সবাই জানি। এ বদভ্যাসটি ছাড়ার নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। যে যার মতো করে চেষ্টা করে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ, পরিবারের সাহায্য কিংবা এ দুটি ব্যাপার মিলিয়ে চেষ্টা করলে সুফল পেতে পারেন। ধূমপানের অপকারী দিকগুলো নিয়ে ভাবুন।
এটা ছাড়ার উপকারী দিকগুলোতে মনোযোগী হতে পারেন। ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করাই শ্রেয়। মদ্যপান এড়িয়ে চলুন। এটা ধূমপানে আপনাকে আরও আকৃষ্ট করবে। শরীরচর্চার মধ্যে থাকলে ধূমপানের ইচ্ছা কমে যেতে পারে। কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে থাকলেও সুফল পেতে পারেন।
ইতিবাচক মনোভাব ও চাপ কমান
হার্ট ভালো রাখতে মানসিক প্রশান্তির বিকল্প নেই। কিন্তু কর্মক্ষেত্র, সমাজ কিংবা পরিবার থেকে মানুষ নানাভাবে চাপে থাকে। এসব চাপ যেমন মোকাবিলা করতে হবে, তেমনি বুদ্ধি করে কমাতেও হবে। প্রতিদিনের কাজের চাপ শেষে নিজের জন্য আলাদা করে একটু সময় বের করুন। পছন্দের গান শুনতে পারেন কিংবা বই পড়তে পারেন।
কোনো কারণে মনে কষ্ট পেলে তা বন্ধু কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করে নিন। মনে কষ্ট পুষে রাখবেন না। এ ধরনের অভ্যাস হৃদ্রোগ ডেকে আনে। সবচেয়ে ভালো হয় পরিবার কিংবা কর্মক্ষেত্রে চমৎকার সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলা। অর্থাৎ, হার্ট ভালো রাখতে মানসিক চাপ কমানো এবং চারপাশের মানুষের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তোলাও জরুরি।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়