Tuesday, June 25

ইসলামী শিক্ষা হতে পারে মাদক নির্মূলের অন্যতম হাতিয়ার

 শহীদুল ইসলাম::

আমাদের জাতীয় একটা সমস্যা হচ্ছে মাদক। এটি শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করে না বরং এর দ্বারা সমাজও ক্ষতিগ্রস্হ হয়। 

সামাজিক নিরাপত্ত, পারিবারিক বন্ধন, অর্থনীতি ও মানুষের জীবন সবকিছু ধ্বসে পড়তে পারে এই মাদকের কারণে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে প্রতি বছর বহু মানুষ মদ খেয়ে মারা যাচ্ছে। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে আরো বহু মানুষ। 
গেলো বছর আঠারোই ফেব্রুয়ারির ঘটনা। ভারতের সাহারানপুর ও উত্তরখন্ডে মদ খেয়ে চল্লিশেরও উর্ধ্বে মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশও ঝুঁকিমুক্ত নয়। মুন্সিগঞ্জে গত কিছু দিন আগে মদ খেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মাদক হিসেবে মদ ছাড়াও রয়েছে ফেনসিডিল, ইয়াবা, হিরোইন ইত্যাদি। 

আইন প্রয়োগকারী সংস্হার চাপে মাদক কারবারিরা এখন নিরীহ পাখিকে মাদক বহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে; যা খুবই শঙ্কার বিষয়। কারণ, এর দ্বারা বার্তা দেয়া হচ্ছে যে, প্রশাসন যত কৌশল করবে আমরা সবকিছুকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম। মাদকের কোনো চালান ধরা পড়লে আমাদের দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে তা শিরোনাম হয়। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আইন শৃঙ্খখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বিবৃতি দেয়। আম জনতার মাঝেও তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু আশংকার বিষয় হচ্ছে, এত কিছু সত্তেও মাদকের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। 
এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, শুধু আইন দিয়ে কোনো একটা বিষয়কে নির্মূল করা কখনো সম্ভব নয়। আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। তাহলেই সম্ভব কোনো বিষয়কে নির্মূল করা। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি সরকার ও প্রশাসনের সকল কৌশল যখন কোনো বিষয়ে অকার্যকর তখন তারা মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করে তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। মাদকের বিষয়ে এই কর্মপন্হা অবলম্বন করা যেতে পারে। মাদকের ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা মানুষকে জানিয়ে তা কাজে লাগানো যেতে পারে। 
সম্প্রতী সময়ে দেখা গেছে মাদক নিরাময়ের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা ও তার অনুশাসন মেলে চলার ওপর খুব গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এতে কাজও হচ্ছে বেশ ভালো। এ সকল বিষয় বিবেচনায় মনে হয়েছে মাদক সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের বাণীগুলো আমাদের সামনে থাকা দরকার। যেন নিজের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনকে তা জানিয়ে মাদকের হাত থেকে বাচানো যায়। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো-
শয়তান মানুষকে মাদকের নেশায় ফেলে টার্গেট বাস্তবায়ন করে:  এক. আল কোরআনের সূরা মায়েদার, নব্বই ও একানব্বই নম্বর আয়াতে মাদকের ক্ষতিকর দিক আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও জুয়ার তীর- (এ সবই ) অপবিত্র, শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা এসব থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান তো এ-ই চায় যে, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখবে। অতএব তোমরা কী নিবৃত্ত হবে?’ উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের মাঝে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।
(ক) মাদক, জুয়া ও এ জাতীয় বিষয় শয়তানের কাজ। সৃষ্টির সেরা মানুষের জন্য তা শোভা পায় না। যারা এগুলোতে লিপ্ত হবে বাহ্যিকভাবে সে মানুষের আকৃতি ধারণ করলেও প্রকৃত অর্থে তার ভেতর রয়েছে শয়তানি।
(খ) আয়াতে সফলতার জন্য মদ, জুয়া ও এ জাতীয় কাজকে পরিহার করে চলতে বলা হয়েছে। বাস্তব জীবনেও আমরা দেখতে পাই যারা মাদকাসক্ত, জুয়ারী তাদের জীবন হয় উশৃঙ্খল। জীবনের পদে পদে ব্যর্থতা। এখানেই শঙ্কা যে, এখন আমাদের যুব সমাজ যেভাবে মাসকাসক্ত হচ্ছে আর জুয়ার ব্যাপকতা যেভাবে বাড়ছে, এ অবস্হা বিদ্যমান থাকলে জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু সফলতা লাভ করতে পারবো? আমাদের দেশে মাদকের বাজার হাজার হাজার কোটি টাকা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলাগুলোতে বিনোদনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে জুয়া। তাই জাতীয়ভাবে এগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।
(গ) জুয়ার আরো কিছু অপকারীতা হচ্ছে আল্লাহর স্মরণ, দ্বীনের বিধি-বিধান বাস্তবায়নে গাফলতি। যারা মাদকাসক্ত বা জুয়ার নেশায় পড়ে যায় তাদের ধর্ম-কর্ম বলতে কিছু থাকে না। অশ্লিলতা, বেহায়াপনাও ওদের মাঝে ব্যাপক হয়ে থাকে। আরেকটি অপকারীতা হচ্ছে ওগুলো দ্বারা পরস্পরের শত্রুতা ও হিংসা বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। যার দ্বারা সামাজিক শৃঙ্খলা ও পারিবারিক শান্তি উধাও হয়ে যায়। আল কোরআনের অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। আপনি বলুন, এর মধ্যে অনেক বড় গুনাহ এবং মানুষের জন্য লাভ ও ক্ষতি রয়েছে।’ আল কোরআনে মাদকের খারাপ দিকগুলো আলোচনা করে তা থেকে যেভাবে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, তদ্রুপ এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো-
মাদকের  বিরুদ্ধে  রাসূল  (সা.) জিহাদ ঘোষণার হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আবু দাউদ (রাহ.)। বর্ণনাকারী হচ্ছেন প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত দায়লাম হিময়েরী (রা.)। তিনি বলেন, একবার আমরা রাসূল (সা.) এর নিকট আরজ করি যে, হে রাসূলুল্লাহ! আমরা প্রচণ্ড ঠান্ডা এলাকায় থাকি এবং সেখানে মেহনতের কাজ করি। আমরা এই শস্য থেকে এক ধরনের মদ তৈরি করি, যা পান করলে আমাদের শীত সহ্য ক্ষমতা ও কাজের শক্তি অনেক বেড়ে যায় (এটা কী আমাদের জন্য বৈধ হবে?) রাসূল (সা.) বলেন, এটা খেলে মাতলামি আসে? সাহাবি বলেন, হ্যাঁ। রাসূল (সা.) বলেন, তাহলে তা থেকে বিরত থাক। সে সাহাবি ওই এলাকার মানুষের মানসিক অবস্হা বুঝতেন। তাই তিনি বলেন, সম্ভবত তারা এটা মানবে না। রাসূল (সা.) বলেন, যদি তারা এটা থেকে বিরত না থাকে তাহলে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। (সুনানে আবু  দাউদ)। 
উল্লেখিত হাদিস থেকে যে বিষয়গুলো বুঝে আসে-
এক. কোনো এলাকার মানুষ যদি মাদকে এত বেশি অভ্যস্ত হয় যে, তা থেকে বিরত থাকা কোনোভাবেই ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলেও ওদেরকে উক্ত অবস্হায় ছেড়ে দেয়া যাবে না। 
দুই. কোনো এলাকার মানুষ যদি সম্মিলিতভাবে মাদকে ঝুঁকে যায় তাহলে প্রয়োজনে সরকার ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। এর দ্বারা এ কথাও প্রতীয়মাণ হয় যে মাদকের নেশা কত গুরুত্বর অন্যায় যে, এর বিরুদ্ধে প্রশাসনকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে। মাদকের অপরাধ গুরুতর হওয়ার যৌক্তিক কারণও আছে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা মাদকে আসক্ত হয়ো না। কেননা, মাদক সকল অন্যায়ের মূল।’ বাস্তবেও দেখা যায়, একজন খুনি বা ডাকাত দ্বারাও যে সকল ঘৃণ্য কাজ সংঘটিত হয় না একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি তা অনায়েসে করে ফেলে। একজন খুনি ব্যক্তি নিজের মা-বোনের ইজ্জত কখনো লুণ্ঠন করতে পারে না কিন্তু মাতাল ব্যক্তি থেকে ওর মা-বোনের ইজ্জত নিরাপদ নয়। কারণ মাতালের কোনো আকল বুদ্ধি থাকে না। সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। 
মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার দায়ে যারা যারা শাস্তির সম্মুক্ষিণ হবে:
মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে যারা শাস্তি পাবেন তাদের কথাও হাদিসে বলে দেয়া হয়েছে। হাদিটি প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আনাস (রা.) এর সূত্রে সুনানে তিরমিজীতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দশ শ্রেণীর ব্যক্তির ওপর অভিশাপ দিয়েছেন। ওরা হচ্ছে, ‘যে আঙ্গুর থেকে মদ তৈরির জন্য রস বের, যে নিজের জন্য বের করায়, পানকারী, যে পান করায়, মদ বহনকারী, যার জন্য বহন করে নিয়ে যায় তাকে, বিক্রেতা-ক্রেতা ও বিক্রয়ের পর মূল্য ভক্ষণকারী।’ এ সকল ব্যক্তির ওপর রাসূল (সা.) লানত করেছেন। উল্লেখ্য রাসূল (সা.) ছিলেন, দয়ার নবী রহমতের সমুদ্র। তিনি কাউকে লানত করার অর্থ হচ্ছে যার অন্যায় সীমা ছাড়িয়েছে। এর দ্বারা আমরা মাদকের অন্যায় কতটুকু গুরুত্বর বুঝতে পারি। অন্যদিকে কোনো বিষয়ের সঙ্গে সামান্য সংশ্লিষ্টতাও অপরাধ ধরা হলে ওই বিষয় কতটুকু সঙ্গিন তা বুঝে আসে। এ সকল হাদিসের কারণে সাহাবায়ে কেরাম মদের ব্যাপারে কোনো আপোস করতেন না। 
একবার হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর বাগানে প্রচুর আঙ্গুর উৎপন্ন হয়। ওই বাগানের কর্মচারী হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে অবগত করান যে, এ বছর প্রচুর আঙ্গুর হয়েছে, যদি অনুমতি হয় তাহলে কিছু আঙ্গুরের রস বের করে রেখে দেবো। তখন মদ সাধারণত আঙ্গুর থেকেই তৈরি হতো। হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) তা অবগত হয়ে পত্র লেখেন। তাতে উল্লেখ করেন, ‘পত্র পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তুমি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে যাবে। এই হচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্হা নেয়ার নমুনা। আজ আমরাও বিভিন্ন সময় মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিতে দেখি। কিন্তু পর্দার অন্তরালে কর্তা ব্যক্তিদের ভিন্ন আচরণের গুঞ্জনও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এই দ্বিমুখি নীতির কারণেই আমাদের সমাজে মাদকের সয়লাব দেখা যাচ্ছে। অন্যথায় আন্তরিকতা থেকে ব্যবস্হা নিলে এমন হওয়ার কথা নয়।
মাদক নিমূলে সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন: 
এ জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের ছোবল থেকে বাঁচানো সরকার একার দায়িত্ব নয়। তাই মসজিদের ইমাম, খতিব, ওয়াজের বক্তা, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণও এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া দরকার। মাদকের ধর্মীয় ও জাগতিক ক্ষতি তুলে ধরে সচেতনতা মূলক প্রচারণা চালানো। এই সম্মিলিত প্রয়াসই বয়ে আনবে সফলতা।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়