Tuesday, June 18

কানাইঘাটে তিন জয়িতার জীবনের কাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদক:

“জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় ২০১৯ সালের জন্য কানাইঘাট উপজেলায় তিন ক্যাটাগরিতে তিনজনকে জয়িতা নির্বাচিত করা হয়েছে। নির্বাচিতরা হলেন- নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী-সালেহা বেগম, সাফল্য অর্জনকারী নারী- ফুলেকারা বেগম ও শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য -চন্দনা রানী চন্দ।

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী সালেহা বেগম:

মোছাঃ সালেহা বেগম, স্বামী-মৃতঃ সিরাজ উদ্দিন, মাতা-সফাতুন নেছা, গ্রামঃ নিজ চাউরা দক্ষিণ, কানাইঘাট, সিলেট।
সালেহা বেগমের জন্মের মাত্র ৬ মাস পরে তার বাবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ঐ অবস্থায় সালেহা বেগমের মাকে শ্বশুর বাড়ি থেকে জোর পূর্বক ভাবে তালাক আদায় করে তার মাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হয়। সালেহা বেগম কে কিছু দিন তার দাদী লালন-পালন করে অন্যত্র দত্তক দিয়ে দেন। দত্তক দেওয়ার কিছুদিন পর সালেহা বেগমের পালক মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর তার লালন-পালন ও দেখাশুনা করার মতো কেউ ছিলনা। এ অবস্থায় পালক পিতা সালেহা বেগম কে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থির করেন। কিন্তু সালেহা বেগমের পালক পিতা শফিকুল হক তাকে অন্যত্র ফিরিয়ে দিতে চাইলে সালেহা বেগম কান্নাকাটি শুরু করেন। তার কান্নাকাটি দেখে পালক পিতার বড় ভাই রফিকুল হক তার লালন-পালন এর দায়িত্ব নেন। লালন-পালন এর আড়ালে রফিকুল হক এর স্ত্রী সালেহা বেগম কে নানারকম শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। এমনকি রফিকুল হক এর স্ত্রী সালেহা বেগম কে ঠিক মতো দু-বেলা খেতে পর্যন্ত দিতেন না। এভাবে সালেহা বেগম অর্ধাহারে ও অনাহারে দিনযাপন করতে শুরু করেন। যখন তার বয়স ১২/১৩ বছর হয় তখন তাকে নারায়ণগঞ্জে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতেও সালেহা বেগম কে শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ এর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তিনি পালক পিতা দ্বারা লালিত-পালিত হওয়ায় এ বিষয় নিয়ে সালেহা বেগম কে নানা রকম কটুক্তি করা হত। কিন্তু নীরবে সব নির্যাতন সহ্য করতেন সালেহা, কোন প্রতিবাদ করতেন না। বিয়ের ১ বছর পর সালেহা বেগমের ১টি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে কটুক্তি ও নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায় তার উপর। ২ বছর পর সালেহা বেগমের আরো একটি কন্যা সন্তান জন্ম হলে তার উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। ছোট মেয়ের জন্মের ১ বছর পর সালেহা বেগমের স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তার স্বামী মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তাকে শ্বশুরালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। শ্বশুরালয় হতে বিতাড়িত হয়ে তিনি আবার পালক পিতার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে তিনি ১টি ছাগল, ২টি হাঁস, ২টি মুরগী কিনে লালন-পালন করে ২ মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেন সালেহা বেগম। তার বড় মেয়ে এস.এস.সি পাশ করে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একটি পুরাতন সেলাই মেশিন কিনে সেলাইয়ের কাজ দ্বারা উপার্জিত অর্থ দিয়ে ছোট মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার চলতে থাকে। বর্তমানে ছোট মেয়ে ৪০’তম বিসিএস এর একজন পরীক্ষার্থী। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও টিউশনি করে কোন রকম সংসার চলছে সালেহা বেগমের। 

সাফল্য অর্জনকারী নারী ফুলেকারা:
ফুলেকারা বেগম চৌধুরী,স্বামীঃ মৃত আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরী, মাতা-মৃত মকলুমা বেগম চৌধুরী, গ্রাম-জয়ফৌদ, ডাক-সড়কের বাজার, উপজেলা-কানাইঘাট, সিলেট।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় ফুলেকারা বেগম কে। বিয়ের মাত্র এক বছর পর প্রথম কন্যা সন্তান এর জন্ম দেন ফুলেকারা বেগম। এরপর তিনি আরো ৪ কন্যা সন্তানের মা হন। বর্তমানে তিনি ৫ কন্যা সন্তানের সফল জননী। ৫ কন্যা সন্তান রেখে ফুলেকারা বেগমের স্বামী মারা যান। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে ৫ কন্যা সন্তান নিয়ে অত্যন্ত দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে থাকেন ফুলেকারা। নিজের ৫ মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেন তিনি। বর্তমানে ফুলেকারা বেগমের প্রথম মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পদে অত্যন্ত সুনামের সহিত কর্মরত আছেন। এ ছাড়াও চতুর্থ  এম.এ এবং পঞ্চম মেয়ে বি.এ তে অধ্যয়নরত।


শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী চন্দনা রানী:

চন্দনা রানী চন্দ, স্বামী-চিন্ময় কুমার চন্দ, মাতা-কল্পনা রানী চন্দ, গ্রাম-মাছুগ্রাম, ডাক-সড়কের বাজার, কানাইঘাট, সিলেট।

চন্দনা রানী চন্দ অত্যন্ত একটি দরিদ্র পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন। তাহার পিতার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। আর্থিক অস্বচ্ছলতার অভাবের কারনে চন্দনা রানী চন্দ কে তাহার পিতা-মাতা ৫ম শ্রেণি পাস করার পর লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। কিন্তু চন্দনা রানী চন্দের  লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল ইচ্ছা ও আগ্রহ। চন্দনা রানী চন্দ স্ব-উদ্যোগে স্কুলে ভর্তি হয়ে ও টিউশনি করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতার সহিত উর্ত্তীণ হন। বর্তমানে তিনি কানাইঘাট ৩নং দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ভিজিটর পদে চাকুরীতে কর্মরত আছেন। কর্মস্থলে অত্যন্ত সুনামের সহিত চন্দরানী চন্দ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন পুরস্কারে সরকারি ভাবে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ২ ছেলের জননী। প্রথম ছেলে ঢাকা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হতে আই.পি.টি তে অর্নাস উর্ত্তীণ ও দ্বিতীয় ছেলে সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে অধ্যয়নরত।


কানাইঘাট নিউজ ডটকম/১৮জুন ২০১৯

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়