Tuesday, June 25

‘আমার মায়ের মাথা খুঁজে পাচ্ছি না, আমার মারে তোলো’

কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বরমচাল সেতু ভেঙে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি বগি ছিটকে খালে পড়লে ৪জন নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিকের বেশি যাত্রী। দুর্ঘটনার সময় ওই ট্রেনে ছিলেন কামরুল ইসলাম মামুন নামে এক যাত্রী। তিনি সিলেটের বাসিন্দা বলে জানা গেছে। দুর্ঘনটার পর তিনি তার নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেথানে তিনি এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা লিখেন।
স্ট্যাটাসে তুলে ধরেন,যা হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার বাসপথে ব্রিজ ভাঙা, সেইসঙ্গে অতিরিক্ত জ্যাম থাকায় বাধ্য হয়ে ২৫০ টাকার টিকিট ৫০০ টাকা দিয়ে নিয়ে ট্রেনপথে রওনা দিলাম। রাত ১০টায় সিলেট থেকে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছাড়লো। তখন আমার টিকিটের গায়ে এক্সট্রা-৫ লেখা দেখে আমার পাশের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই লেখার মানে কি এক্সট্রা বগি না।
ভদ্রলোক বললো, অতিরিক্ত লাভের আশায় ৫-৬টা বগি এক্সট্রা লাগানো হয়েছে। বাসপথে জ্যাম থাকায় ট্রেনে ভিড় প্রচুর। এখন একটু অবাক হলাম! ২৫০ টাকার টিকিট ৫০০ করে বিক্রি করছে তাও আবার অতিরিক্ত মানুষ নেওয়ার জন্য ৫-৬টা বগি এক্সট্রা লাগাইসে বিষয়টা বেশি হয়ে গেল না, প্রশাসন তাদের কোনো খবর নেয় না।
যাক! ট্রেন চলছে। আমার পাশের সিটে একজন সিলেটের বড় ভাই ছিলো। আমি ছিলাম জানালার পাশে। আমার বামপাশের জানালার পাশে একজন ভদ্রমহিলা এবং উনার মেয়ে, উনার পাশে একজন বয়স্ক লোক এবং অনেকগুলো মানুষ দাঁড়ানো, আমার ঠিক পিছনেও অনেকগুলো মানুষ দুই বগির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি এক্সট্রা-৫ বগির ৬০ নাম্বার অর্থাৎ সর্বশেষ সিটে। বরমচর, কুলাউড়া এসে একটা ব্রিজ পড়ে ওইখানে আসতেই এক্সট্রা-৪ থেকে মানে আমার সামনের বগি, আমার বগি এবং পিছনের বগি ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ট্রেনের নিচে ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট হওয়া আগুন দেখে আমরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই, বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে! কি করবো! সব সেকেন্ড তিন-চারেকের মাঝে হয়ে গেল। এই সময় ট্রেনের ওভার গতি ছিল। ১৪০-১৫০ কিলোমিটারের মতো হবে।
আমাদের বগিটা এপাশ-ওপাশ হয়ে বড় একটা ধাক্কা খেলো। ঠিক তখনই আমি বুঝলাম, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না একদম। ভয়াবহ কিছু হতে যাচ্ছে। আল্লাহ সহায় ছিল। আমি যে পাশে ছিলাম এই পাশটা মাটিতে লেগে যাবে লেগে যাবে মনে হচ্ছিল। যদি আমার পাশটা মাটিতে লাগতো তাহলে আমি সবার নিচে পড়ে যেতাম, তখন হয়তো খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো। তখন একটা বড় ধাক্কা খেয়ে আমার বামপাশটা উল্টে যায়। যেহেতু আমি বিপরীত দিকের জানালায় তাই আমি সবার উপরে এসে পড়লাম।
একপাশে আগুন জ্বলছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে ট্রেনের একটা অংশে ধরলাম কিন্তু আবার পড়ে গেলাম। ভাগ্য ভালো ছিল আমার, একজনের মাথায় পড়ি। তখন হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল।
আমি একজনের মাথা থেকে আবার লাফ দিলাম এবং জানালাটা ধরতে সক্ষম হই। জানালা দিয়ে বের হয়ে দেখি আমার পিছনের বগিটা পানিতে পড়ে আছে। আমি যেটাতে ছিলাম এইটা আর আমার সামনের বগিটা উল্টে আছে। মাটিতে নেমে আসলাম।
আমার হাত পা কাঁপছিলো, মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো না। ব্যাগটা ট্রেনেই ছিল, আমি কোনো রকম নিজের জীবন নিয়ে বের হয়ে আসি। ব্যাগে কিছু দরকারি কাগজ আর অনেকগুলা টাকা ছিলো তাই ভাবলাম ব্যাগটা আনা যায় কিনা। আর সবচেয়ে বাজে সময়টা তখনই।
আমি ট্রেনের পাশে এসে দেখি আমার পিছনে যে ছেলেগুলা ছিল, তার মাঝে একজন দুই বগির নিচে পড়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ লোকটার হাত কেটে পড়ে গেছে, বাম পাশের মহিলার মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। উনার মেয়ে বডিটা নিয়ে চিৎকার করছে, ‘আমার মার মাথা পাচ্ছি না, কেউ আমার মারে তোলো’।
মেয়েটা তার মায়ের মাথা খুঁজছে, সামনের একজনও বগির নিচে পড়ে গেছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আজ যদি আমার পাশটা নিচে পড়তো তাহলে হয়তো ওই মহিলার জায়গায় আমার বডিটা থাকতো।
আমি একটা খালি জায়গায় গেলাম। তারপর ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, গ্রামের লোকজন সবাই আসলো। একের পর একজন বের করছিলো। কারও হাত নাই, পা নাই, কেউ মৃত, আবার কেউবা মারাত্মক আহত। কয়েকটা লাশ বস্তায় করে বের করতে দেখলাম। এই লাশগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ।
২০ মিনিটের ভিতরে ২১টা লাশ বের করলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কি করবো! কি করা উচিত আমার। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই পাঁচটা মিনিট আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়। তিন বগিতে ৩০০ জনের উপরে ছিলো। তার মাঝে হাতে গুণা কয়জন সুস্থ অবস্থায় বের হয়ে আসছে। আল্লাহ সহায়, তার মাঝে আমি একজন।
হয়তো অতিরিক্ত বগি লাগানোর কারণেই এই দুর্ঘটনার জন্ম। তাদের কয়টা টাকার জন্যই হয়তো আজ এতগুলা প্রাণ গেলো, এতোগুলো মানুষ আহত হলো। আর ট্রেনের ওভারলোড তার একটা কারণ হতে পারে। আল্লাহর রহমতে আমি সুস্থ অবস্থায় রাত ৩.৩০ এর দিকে সিলেট আসছি। আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করুন।
আমার কানে যেন এখনো আর্তনাগুলো শুনছি, আমার চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে। যেন এখনও আমি মেয়েটার চিৎকার শুনতে পাই, ‘আমার মায়ের মাথা খুঁজে পাচ্ছি না, আমার মারে তোলো’

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়