কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় একটি
গ্রামকে সে দেশের মানুষ ‘মা ছাড়া গ্রাম’ বলে ডাকে। কারণ সেই গ্রামের প্রায়
সব শিশু মা ছাড়াই বেড়ে উঠছে। সেখানকার অল্প বয়েসী মায়েদের প্রায় সবাই
কাজের খোঁজে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন।
এদেরই একজন এলি সুশিয়াতি। তার মা যখন তাকে
তার দাদীর কাছে রেখে যান সে সময় তার বয়স মাত্র ১১ বছর। এর আগে তার
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে। তখন পরিবারের সবার মুখে দুটো খাবার তুলে দেবার
চিন্তা থেকেই গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে চলে যান এলির মা। এলি এখন
দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে।
সে জানিয়েছে, মা চলে যাবার পর সেই সময়টা কী কষ্টে কেটেছে! মায়ের সঙ্গে দীর্ঘ সেই বিচ্ছেদের ব্যথা যেন এখনো তার চোখ মুখে।
সে বলে, ‘আমার ক্লাসের বন্ধুদের
বাবা-মায়েদের যখন যখন দেখি, তখন আমার মনটা তিতা হয়ে যায়। কত বছর ধরে আমি
অপেক্ষা করছি মা আসবে! আমি চাইনা আমার মা আর বিদেশে কাজ করুক, আমি চাই তিনি
দেশে ফিরে আসুক। আমাকে আর আমার ভাইবোনদের কাছে থাকুক।’
দেশটির পূর্ব লম্বকের গ্রাম ওয়ানাসাবাতে
থাকে এলি। সেখানে এটাই স্বাভাবিক যে সন্তানদের উন্নত জীবন দিতে অল্প বয়েসী
মায়েরা পরিবার ছেড়ে বিদেশে কাজ করতে যাবে।
এখানকার পুরুষেরা কৃষিকাজ করে কিংবা
কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। পরিবারের নারীদের আয়ের তুলনায় এদের আয়
একেবারেই নগণ্য। গ্রামটির প্রতিটি বাড়ি একটির গায়ে আরেকটি লাগোয়া, পুরো
গ্রামে সারি সারি বাড়ি। মাঝের গলিও একেবারে সরু, কোনমতে দুটো মোটর সাইকেল
পাশাপাশি চলতে পারে। বাড়ির পেছনে বিশাল ধানক্ষেত।
যখন মায়েরা ছোট বাচ্চা রেখে বিদেশে যায়,
তখন পরিবারের পুরুষ ও বয়স্ক সদস্যরা সন্তান পালনের দায়িত্ব নেয়। এই
গ্রামের প্রতি পরিবারেই যেহেতু মা প্রবাসী। দেখা গেছে সব পরিবারই সবার
বাচ্চা দেখে শুনে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন মায়েরা বাড়ি ছেড়ে যায়,
সন্তানদের বিদায় জানানোই যেন তখন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।
কারিমাতুল আবিদিয়ার মা যখন বিদেশে যায়,
তখন তার বাচ্চার বয়স এক বছর। ফলে সেই কষ্টের স্মৃতি আবিদিয়ার মনে নেই।
তার প্রাইমারি স্কুল যে বছর শেষ হয়, সে বছর তার মা দেশে ফিরে এসেছিল।
ততদিনে আবিদিয়া তার খালাকে মা ভাবতে শিখেছে। কেননা তিনিই যে তাকে কোলেপিঠে
করে বড় করেছে।
সুতরাং তার মা যখন ফিরে এলো, সে খুবই
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তার মনে আছে, তার মা রোজ কাঁদত আর অভিযোগের
সুরে তার খালাকে জিজ্ঞেস করতো, ‘ও কেন জানে না যে ও আমার বাচ্চা?’
খালা জবাব দিতো, আবিদিয়ার মায়ের কোন ছবি
ছিলো না বাড়িতে। স্মৃতি বলতে মায়ের নাম আর তার কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা, যা
ছোট একটি বাচ্চার কাছে হয়ত কোন অর্থই বহন করে না। এখনো যখন তার মা দেশে
আসেন, তখনও আবিদিয়া তার খালার কাছেই থাকে। মা কাছে থাকতে বললে আবিদিয়া
দূরে দূরে থাকে।
তার খালা বাইক নুরজান্নাহ আরো নয়টি
বাচ্চাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, এর মধ্যে কেবল একটি তার নিজের সন্তান।
এ বাচ্চাগুলো তার বোনেদের বা ভাইয়ের বউদের।
‘কিন্তু আমি কাউকে আলাদা চোখে দেখি না। ওরা
সবাই আপন ভাইবোনের মতই। ওদের কেউ অসুস্থ হলে বা ওদের কিছু লাগলে আমি
আলহামদুলিল্লাহ পাশে থাকতে পারি।’
১৯৮০ দশক থেকে ইন্দোনেশিয়ার এ অঞ্চল থেকে
নারীরা গৃহকর্মী ও আয়া হিসেবে কাজ করতে বিদেশে যাওয়া শুরু করেন। কোনো
ধরণের নিরাপত্তা ছাড়া বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় তারা নিপীড়নের
শিকার হন। উন্নত জীবনের খোঁজে গিয়ে কফিনে করে ফিরে আসার অনেক ঘটনা রয়েছে।
কেউ কেউ শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন, কেউ বা নিয়মিত বেতন পান না।
অনেক সময় দেখা যায়, এসব মায়েরা আরো
সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, এসব বাচ্চা কর্মস্থলে যৌন নির্যাতনের শিকার
হয়ে প্রবাসী ঐ নারীর গর্ভে জন্মানো বাচ্চা। ভিন্ন জাতি পরিচয়ের এসব
বাচ্চাও অন্য বাচ্চাদের সাথে মিলেমিশে এ গ্রামে থাকে। চেহারা বা গায়ের রং
ভিন্ন হবার কারণে হয়ত কিছুটা বেশি মনোযোগ পায় আর সবার কাছে।
আঠারো বছর বয়েসী ফাতিমাহ জানায়, সেই
বাড়তি মনোযোগ তার ভালোই লাগে। ‘মানুষজন আমাকে দেখে বিস্মিত হয়। কেউবা বলে
তুমি খুব সুন্দর কারণ তোমার গায়ে আরব রক্ত রয়েছে। আমার এসব শুনতে খুব
ভালো লাগে।’
কিন্তু এ ধরণের বাচ্চাদের সেখানকার সমাজে খাটো করেও দেখা হয় এবং স্কুলেও এরা নিপীড়নের শিকার হয়।
ফাতিমা কখনো তার সৌদি বাবাকে দেখেনি। কিন্তু
তিনি ইন্দোনেশিয়ায় ফাতিমার মায়ের নামে টাকা পাঠাতেন। কিন্তু কিছুদিন
আগে তিনি মারা যান, এখন ফাতিমার মাকে আবার বিদেশে যেতে হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার প্রবাসী আয়
দেশটির প্রবাসী শ্রমিকের দুই তৃতীয়াংশের বেশি নারী শ্রমিক। তাদের পাঠানো অর্থে চলে সন্তানদের ভরণপোষণ।
গত নয় বছরে এলি তার মাকে দেখতে পায়নি,
কিন্তু তার মায়ের পাঠানো অর্থের কারণেই এলি আজ তার গ্রামের প্রথম মেয়ে যে
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। এলির মা জানিয়েছেন, তার মেয়ে যে কঠিন
মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছে, সেজন্য তিনি খুব খুশী।
এলি বিবিসিকে জানিয়েছে, যে সে এখন তার মায়ের ত্যাগ বুঝতে পারে।
‘আমার কর্মজীবন অবশ্যই ভিন্ন হবে। কারণ আমি
বুঝি আমাদের মায়েদের শিক্ষার অভাবের কারণেই তাদের আমাদের ছেড়ে দূরে চলে
যেতে হয়েছিল। এটাই আমাদের মনে রাখতে হবে। আমি কিছুতেই আমার মায়ের মত
সেখানে যাব না, আমি গেলে বরং ওদের সাথে ব্যবসায়িক চুক্তি করবো।’
খবর বিভাগঃ
দেশের বাইরে
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়