Wednesday, May 29

ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ:) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী


হাফিজ মাওলানা আব্দুল্লাহ::

মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বযুগে এমন কিছু মহামানব সৃষ্টি করেন যাঁরা মরেও অমর হয়ে থাকেন। যাঁদের বিয়োগে দুনিয়াবাসী কেঁদে ওঠে। আর তাঁরা হেসে হেসে আপন প্রমাষ্পদের সান্নিধ্যে চলে যান। যাঁদের বিরহ জ্বালায় মানুষ কাতর হয়ে পড়ে আর তাঁরা পরম আনন্দের কুল বিছানায় ঘুমিয়ে যান। যাঁরা পুষ্পের মতো সৌরভ ছড়িয়ে যান পৃথিবীর মাঝে যা নিঃশেষ হয় না কখনো, রেখে যান মহৎ আদর্শ ও অমর কীর্তি। তাঁরা আসলে মরেন না, স্মৃতির আয়নায় তাঁরা হয়ে থাকেন চিরভাস্বর ও অমর। তাঁদেরই মধ্যে নির্ঘন্টে সোনার অক্ষরে লেখা একটি নাম শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ রাহিমাহুল্লাহু তা'আলা (ছোটদেশী মুহাদ্দীস সাব হুজুর)

জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ
১৯২১ সালে সিলেট জেলার অন্তর্গত পুন্যবানদের অন্যতম ঘাটিখ্যাত কানাইঘাট থানার ছোটদেশ গ্রামের ছোটফৌদ মহল্লার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, ক্ষণজন্মা এই প্রাজ্ঞ শায়খুল হাদীস। পিতার নাম- মাওঃ ক্বারী মুবাশ্বির আলী (রাহ.), মাতার নাম -আসহামা বিবি। শায়খ আবদুল্লাহ রহ.জন্মগতভাবেই প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। শৈশবেই তাঁর মেধার বিভা ফুঁটে উঠে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁর শিক্ষাদীক্ষা শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের প্রাত্যুষিক মকতবে। এরপর ছোটদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়া করেন। অপরুপ নিসর্গশোভা মায়াবী পরিবেশে শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো তিনি অতিক্রম করেন। মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন বলে বাল্যকাল থেকেই তাঁর চিন্তা চেতনা এক অসম ব্যাপ্তি লাভ করে। পিতা- মাতার স্নেহছায়ায় থেকে সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের কঠিন পাঠগুলো সহজেই আত্মস্থ করে নেন। শিশুকাল থেকেই তাঁর সত্তায় লুকিয়ে ছিলো দ্বীনে ইলাহীর তীব্র তৃষ্ণা। আরাধ্য ইবাদতে ছিলেন অনুস্বরণীয়। তাই প্রাথমিক শিক্ষার্জনের পর দ্বীনি ইলম অর্জনে পার্শ্ববর্তী উমরগনজ ইমদাদুল উলূম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে সেখানে কাফিয়া পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখা পড়া করেন। 

উচ্চশিক্ষার জন্য নিজ এলাকা ত্যাগঃ
উমরগনজ মাদ্রাসায় কাফিয়া পর্যন্ত অধ্যয়ন করে উচ্চ শিক্ষার্জনে তৎকালীন প্রসিদ্ধ বিদ্যানিকেতন গাছবাড়ী জামিউল উলূম কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। অতঃপর সেখানে থেকেই ১৯৫২ইং ১ম বিভাগে কামিল সমাপ্ত করেন। গাছবাড়ী মাদ্রাসায় তাঁর উস্তাদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী ও ফাজিল সাব রাহিমাহুমাল্লাহ প্রমুখ। অতঃপর তাফাক্কুহ ফীদ – দ্বীন অর্জনের লক্ষ্যে নিজের আসাতেযায়ে কেরাম, আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের পরামর্শক্রমে বিশ্বখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে ২ বছর শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাঃ এর নিকট পড়াশুনার পর ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সহিত ১ম বিভাগে দাওরায়ে হাদীসের সনদ অর্জন করেন। এ বছর ই পাকিস্থান গমন করে লাহুরে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রাহ. এর নিকট তাফসির অধ্যয়ন করে তাফসিরের ডিগ্রী অর্জন করেন। অতপর করাচী গমন করে দারুল উলুম করাচীতে মুফতি সাব্বির আহমদ উসমানী রাহ.এর তত্ত্বাবধানে ফতোয়া বিভাগে অধ্যয়ন করে ১৯৫৭ সালে মুফতি ডিগ্রী অর্জন করে বাড়িতে ফিরে আসেন। 

কর্ম জীবনঃ
১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসাবে যোগদান করে ৬ মাস পর ইস্তেফা দিয়ে চলে আসেন। অতঃপর দিলগ্রাম বিয়ানিবাজার মাদ্রাসা ,মদীনাতুল উলুম খরিল হাট মাদ্রাসা ,দারুল উলুম হেমু মাদ্রাসা ,সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসা ,বিশ্বনাথ মাদানিয়া মাদ্রাসা ,জামেয়া ইসলামিয়া রাজাগনজ মাদ্রাসা ,জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসা ,বরায়া আলিয়া ছাতক মাদ্রাসা ,বালিংগা বিয়ানীবাজার মাদ্রাসা ,হাড়ী কান্দী জকিগন্জ মাদ্রাসা ,তালবাড়ী এবং ঢাকা দক্ষিণ মাদরাসায় শায়খুল হাদীস হিসাবে মোট ৬০ বছর বোখারী শরীফসহ সিহাহ সিত্তার কিতাব সমুহের দারস প্রদান করেন। 

সহপাঠীঃ
তাঁর সহপাঠীদের মধ্য থেকে অন্যতম হলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা ফয়জুল বারী মহেষপুরী রাহ.ও শায়খ আবদুল মুমিন শায়খে ইমামবাড়ী। ছাত্রঃতার ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম হলেন দারসে বুখারীর লেখক শায়খুল হাদীস আল্লামা ইসহাক রাহিঃ এবং মুফাসসিরে কুরআন মাওঃ আবু তায়্যিব সৎপুরী। ওয়াজ নসিহতঃশায়খুল ইসলাম আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রাহ. এর জীবদ্দশায় দারুল উলুম কানাইঘাটের জলসায় তিনি বাদ যোহর বয়ান পেশ করতেন। শায়খ শহর উল্লাহ রাহিঃ এবং শায়খ ফয়জুল বারী রাহিঃ এর সময়ে নিয়মিত বাদ মাগরীব বয়ান পেশ করতেন।এছাড়াও তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে শরীক হয়ে উম্মাহকে দিকনির্দেশনা দিতেন। তিনি ছোটদেশ শাহী ঈদগাহের সম্মানিত খতীব ও ইমাম ছিলেন। তার বয়ানে ছিলো না কোন সূর, নেই কোন অতিরিক্ত টান। সাবলীল ভাষায় কুরআন ও হাদীসের বাণী প্রচার। বজ্রকণ্ঠে বাতিলের মুখোশ উন্মোচন করতেন তিনি। কুরআন ও হাদীস নিংড়ানো পাহাড়সম ভারী দালীলিক বয়ানে উন্মোচিত হতো বাতীলের মুখোশ। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা বাচন ভঙ্গিমা যার অবয়ব জুড়ে ছিলো । বাঙ্গালির চিরচায়িত পোষাক লুঙ্গি , সেন্ডেল সাথে সেকাব্বন আর কিস্তি টুপি পড়া একজন সহজ সরল.নিরহংকার মানুষ ছিলেন তিনি । দেখতে একেবারে সাদামাটা এক মৌলভী । মুখে পানের খিলি আর সহজ সরল চলন বলনে এক সুফি দরবেশ ছিলেন তিনি । এতোটা সাদামাটা আমার চোঁখে আর কোন জনপ্রিয় ব্যক্তিকে দেখিনি । এই সাদামাটা সহজ সরল মুখলেছ মানুষটিকে আল্লাহ তায়ালা এক খাছ নেয়ামত দান করেছেন যা হলো ইলমে হাদীসের ইলম। এই বরেণ্য আলেমের এলেমের রৌশনীতে আজ আলোকিত পুরো সিলেট। তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন । কত বিশাল হৃদয়ের মানুষ। যারা হযরতের কাছে গিয়েছেন। যারা হযরতের কথা শুনেছেন। তারা একথা অকপটে স্বীকার করার কথা। তাঁর দীপ্ত চরিত্রের প্রচন্ড মোহময়তার চৌম্বক শক্তি যে কোন মানুষকে কাছে টেনে আপন করে নিত। তাঁর শান্ত, সৌম্য ও নিষ্কলুষ অবয়ব মুহূর্তেই যে কোন সাক্ষাতপ্রার্থীর হৃদয়ে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে দিত। সমুদ্রসম ইলম, প্রজ্ঞা ও সজ্ঞার ধারক হওয়া সত্ত্বেও সহজাত বিনয়, নিরহংকার আচরণ, মার্জিত ব্যবহার, শালীন বাকরীতি শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ ছোটদেশী রহ. সাহেবের কীর্তি ও খ্যাতির মুকুটে যোগ করেছে কনকশোভা। আমরা যদি তাঁকে গ্রহণ করি চিন্তা -ও কর্মের এবং পথের ও মঞ্জিলের রাহবারুপে তাহলে ফিতনা- ফাসাদের এ যুগে নিরাপদ হতে পারি সকল স্খলন ও পদস্খলন থেকে।

ইন্তেকালঃ ক্ষণজন্মা এ কর্মবীর ও মুখলেস বুজুর্গ ১৮ রমযান ২৪ মে ২০১৯ রোজ শুক্রবার সকাল ১১ টা ৪৫ মিনিটে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ পাক তাঁকে যেন জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন।( আমিন)।

লেখক: হাফিজ মাও.আবদুল্লাহ,ছোটদেশ,সতিপুর, কানাইঘাট সিলেট।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়