Thursday, June 29

অনিশ্চিত গন্তব্যে সৌদি আরবের নতুন ক্রাউন প্রিন্স

অনিশ্চিত গন্তব্যে সৌদি আরবের নতুন ক্রাউন প্রিন্স

কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: সৌদি আরবের  ভবিষ্যৎ শাসক হিসেবে পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম ঘোষণা করেছেন বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। সম্প্রতি বাদশাহর ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে দিয়ে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করা হয় ৩১ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমানকে।

তিনি যে সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ হতে যাচ্ছেন তার ইঙ্গিত আগেই পাওয়া গিয়েছিল যখন তাকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সামনের সারিতে চলে আসেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরে বিন সালমান ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাকে এমন এক সময় ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করা হলো যখন উপসাগরীয় অঞ্চলে বড় ধরনের অস্থিরতা চলছে এবং এর নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন বিন সালমান।

মোহাম্মদ বিন সালমান আরব বিশ্বে অনেকটা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে সৌদি আরবের হাল ধরেছেন। আরব বিশ্বে আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব দ্রুত নানামুখী মেরুকরণ ঘটছে। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপকে কেন্দ্র করে জিসিসি দেশগুলোর মধ্যে ভাঙন ধরছে। দীর্ঘদিন থেকে ইরানবিরোধী দেশগুলোকে একত্র করে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে সৌদি আরব। এ পরিস্থিতি এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ইরানের সাথে সম্পর্ক নতুন করে মূল্যায়ন করছে তুরস্ক, কুয়েত এবং ওমান। একই সাথে সিরিয়া প্রশ্নে হামাস ও হিজবুল্লাহ দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আবার ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জিসিসিভুক্ত চার দেশের। অভ্যন্তরীণ জনমতের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে সৌদি আরবের নতুন ক্রাউন প্রিন্সের জন্য সামনের দিনগুলো সুখকর তো নয়ই আরো সঙ্ঘাত ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হতে পারে।

এদিকে সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ নির্ধারণে ক্রাউন প্রিন্স নির্বাচনকে এক ধরনের অভ্যুত্থান হিসেবেও দেখা হচ্ছে। ক্রাউন প্রিন্সের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া মোহাম্মদ বিন নায়েফ যথেষ্ট ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সৌদি আরবের ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ও দাপুটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কাউন্টার টেরোরিজমের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হতো। তিনি নিজেও একবার সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়েছিলেন। নায়েফ লেখাপড়া করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বলছে কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের ব্যাপারে বিন সালমানের সাথে তিনি একমত ছিলেন না। যদিও নতুন ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণার অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন আমি অবসরে যাচ্ছি। অপর দিকে নতুন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, আমি তোমার পরামর্শ ছাড়া কিছুই করব না।

নতুন ক্রাউন প্রিন্স সৌদি আরবকে কোন পথে এগিয়ে নেবেন তা এখন আলোচনার প্রধান বিষয়। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনায় তার ভূমিকা হবে মুখ্য। কারণ বর্তমান বাদশাহ কিছুটা স্মৃতি বিভ্রাট জনিত সমস্যায় ভুগছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। বিন সালমানকে আগামী দিনে দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতিতে সৌদি পররাষ্ট্রনীতির গন্তব্য নির্ধারণ এবং নিম্নমুখী অর্থনীতির গতি সঞ্চারে। অভিজ্ঞতাহীন এই তরুণ যে ঝুঁকি নিতে ভালোবাসেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন।

ইয়েমেন যুদ্ধের তিনি ছিলেন রূপকার। কিন্তু এই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। ইয়েমেন যুদ্ধে ইতোমধ্যে ১০ হাজার লোক মারা গেছে। হুথিরা রাজধানী সানা নিয়ন্ত্রণ করছে, অপর দিকে দক্ষিণ ইয়েমেনে সৌদি সমর্থিত মনসুর হাদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। এই যুদ্ধের শেষ কোথায় তা এখনো অনিশ্চিত। এরমধ্যে কাতারের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন ক্রাউন প্রিন্স। সৌদি আরবের নেতৃত্বে চারটি উপসাগরীয় দেশের অবরোধ তুলে নেয়ার শর্ত হিসাবে ১৩ দফা দাবি দেয়া হয়েছে। এসব দাবি কাতার মানবে না বলে জানিয়েছে। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ তুরস্ক ও ইরানকে এ অঞ্চলে আরো বেশি প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। বিন সালমান এই মুহূর্তে ইরান, ইয়েমেন, সিরিয়া ও কাতারে বড় ধরনের সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। এ কারণে তাকে দ্য প্রিন্স অব ক্যাওয়াস নামে অভিহিত করা হচ্ছে।

বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেন। মনে করা হয় ট্রাম্পের জামাই জ্যারেড কুশনার ও ইহুদি লবির তিনি জোরালো সমর্থন পাবেন। সরিয়ে দেয়া ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফও ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ফলে নতুন ক্রাউন প্রিন্সের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের সাথে এক ধরনের বোঝাপড়া করতে হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নতুন ক্রাউন প্রিন্সের নাম ঘোষণার আগে প্রায় এক সপ্তাহ ওয়াশিংটনে কাটান সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবাইর। নতুন ক্রাউন প্রিন্সের দায়িত্ব গ্রহণের পর ইসরাইলের তথ্যমন্ত্রী আইয়ুব কারা এক বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটনের সাথে ইসরাইলের সম্পর্কে পরিবর্তন আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।

বিন সালমানের প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষ আস্থা অর্জন করেছেন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ। ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সকে সম্ভবত তিনি দুটি পরামর্শ দিয়েছেন। এক. ইসরাইলের সাথে সরাসরি সম্পর্ক সৃষ্টি করা এবং দেশটির আস্থা অর্জনে হামাসকে কালো তালিকাভুক্ত করা। দুই. অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শাসন পরিচালনায় উলেমাদের ক্ষমতা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা। এ ক্ষেত্রে ভিন্নমতাবলম্বীদের ব্রাদারহুডের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে চাপের মুখে রাখা। সৌদি নীতিতে ইতোমধ্যে এর প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

নতুন ক্রাউন প্রিন্সের জন্য অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সৌদি আরবের অর্থনীতি এখন চাপের মধ্যে রয়েছে। দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২০১৪ সালে ৭৩০ বিলিয়ন ডলার, গত মাসে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯৩ বিলিয়ন ডলারে। দেশটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে। যদিও বিন সালমান তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে দেশকে বের করে আনার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সৌদি আরামকোর শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু যেভাবে তিনি অস্ত্র কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন তাতে এর প্রভাব দেশটির অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবে। ইতোমধ্যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নানা ধরনের অস্ত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। যার মধ্যে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কেনা।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়