Wednesday, May 4

ছিটমহলবাসীর মধ্যে ভোটের আনন্দ

কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রথমবার ভোট দেবেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মশালডাঙ্গা গ্রামের ১০৩ বছর বয়সী আজগর আলি। মশালডাঙ্গা কোচবিহার জেলায় যুক্ত হওয়া এক সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহল। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী আজগর আলিই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সবথেকে বেশি বয়সের ভোটার। আজগর আলির পরিবারের তিন প্রজন্ম একসঙ্গেই সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র পেয়েছেন কদিন আগে। একই সঙ্গে ভোট দেবেন সাবেক ছিটমহলগুলোর প্রায় দশ হাজার মানুষ। নাগরিকত্বহীন অবস্থায় সাড়ে ছয় দশক কাটানো পরে এবারই প্রথম নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করবেন তাঁরা। আরেকটা সাবেক ছিটমহল পোয়াতুরকুঠির বাসিন্দা মনসুর মিঞাঁর বয়স ৭৬ বছর। জন্মের পর থেকে ভারত, পূর্ব পাকিস্তান, শেষমেশ বাংলাদেশের ভূখন্ডে থাকতেন। কিন্তু সাড়ে ছয় দশক কোনও দেশের নাগরিকত্বের কোনও অধিকারই পান নি তিনি – ছিটমহলগুলোর অন্যান্য মানুষের মতো। কদিন আগে প্রথমবার হাতে পেয়েছেন নাগরিকত্বের প্রমাণ – ভারতের ভোটার কার্ড। “বাপ-দাদারা যা পায় নি, সেই নাগরিকত্বের প্রমাণই এবার হাতে পেলাম ৬৭-৬৮ বছর পরে। গর্ব হচ্ছে এই ভোটার কার্ড পেয়ে,” বলছিলেন মনসুর মিঞাঁ। প্রথমবার নিজের নাগরিকত্বের প্রমাণ – সচিত্র ভোটার কার্ড হাতে পেয়েছেন সাবেক ছিটমহলগুলোর ৯৭৭৬ জন। এদের মধ্যে রয়েছেন ৫৭৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক – যারা বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলি থেকে চলে এসেছেন মূল ভূখন্ডে, এখন তাদের রাখা হয়েছে কয়েকটা অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে। দিনহাটা শহরে এরকমই একটা আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন সাবেক ভারতীয় ছিটমহল দাশিয়াড়ছড়া আর ছোটগারালঝোরা থেকে ভারতে চলে আসা ভারতীয় নাগরিকেরা। দাশিয়ারছড়া থেকে ভারতে এসেছেন আশি বছর বয়সী ধীরেন্দ্র বর্মন। এই প্রথম ভোট দিতে যাবেন তিনি। তবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর অনেক বাসিন্দাই আগে একবার ভোট দিয়েছেন। ১৯৭৮ -৭৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সেদেশ থেকে ভারতের মধ্যে দিয়ে ছিটমহলে ভোট করাতে এসেছিলেন আধিকারিকেরা। বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলের অনেকে আবার ভারতের নির্বাচনেও ভোট দিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিয়ে ভুয়া ভোটার কার্ড তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন এরা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কথা বলতে রাজি হয়েছিলেন এরকমই কয়েকজন সাবেক ছিটমহলবাসী। তারা বলছিলেন, “ছিটের বাইরে গেলেই পুলিশ আর বিএসএফ হেনস্থা করত। তাই বাধ্য হয়েই বাপ-মায়ের পরিচয় লুকিয়ে অবৈধ ভাবে ভারতের ভোটার কার্ড বানিয়েছিলাম। ভোটও দিয়েছি একবার। হাজার দশেক টাকা লেগেছিল কার্ড বার করতে। তবে এখন বৈধ ভোটার কার্ড পেয়ে গেছি সবাই।“ গ্রামের মানুষ যখন ৫ মে দল বেঁধে ভোট দিতে যাবেন, তাদের সঙ্গে ভোট দিতে যাওয়া হবে না মশালডাঙার তালেব আলির মতো সাবেক ছিটমহলগুলোর প্রায় শ তিনেক মানুষের। ভোটার তালিকায় নামই ওঠে নি এদের। তালেব আলির মতোই অবস্থা মশালডাঙার আরও দশটি পরিবারের – তাদেরও নাম ওঠে নি ভোটার তালিকায়। আবার পোয়াতুরকুঠিতে বহু সাবেক ছিটমহলবাসীর ভোটার পরিচয় পত্র ভুলে ভর্তি। কোথাও বাবার নামের জায়গায় স্বামীর নাম লেখা, কারও আবার নামটাই ভুল লেখা। প্রশাসন অবশ্য আশ্বস্ত করেছে যে ভুলত্রুটিগুলো পরে সংশোধন করে দেওয়া হবে, এবারে এই ভোটার কার্ড নিয়েই প্রথমবার ভোট দিতে পারবেন সাবেক ছিটমহলের মানুষ। প্রথমবার ভোট এদের , তাই আশ্বস্ত করার পাশাপাশি নির্বাচনী আধিকারিকরা নকল ভোটিং যন্ত্র নিয়ে গিয়ে সাবেক ছিটমহল বা অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরের সবাইকে প্রশিক্ষণও দিয়েছেন যে কীভাবে ভোট দিতে হবে। প্রশাসনের আধিকারিকেরা যেমন বারে বারে ভোটের কাজে যাচ্ছেন সদ্য ভারতে যুক্ত হওয়া সাবেক ছিটমহলগুলোতে, তেমনই যাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা, প্রার্থীরাও – ভোট চাইতে। “ভোট তো চাইতে আসছে সবাই, কিন্তু নয় মাস হয়ে গেল এখনও তো কোনও কাজই শুরু করল না ভারত সরকার। এখনও বিদ্যুৎ আসে নি, রাস্তা হয় নি, স্কুল হয় নি, জমির মালিকানা কী হবে সেটা জানি না!” ক্ষোভ কয়েকজন গ্রামবাসীর। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেই সাবেক ছিটমহল এলাকাগুলোতে ঢুকে পড়েছে রাজনীতিও। ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে সবাই যেমন আগে জোটবদ্ধ ছিলেন, সেই ঐক্যে চিড় ধরতে শুরু করেছে একটু একটু করে। কেউ ঝুঁকেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে, তো কেউ বামপন্থীদের দিকে – ঠিক যেমন দলাদলি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য গ্রামগুলোতেও।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়