Sunday, November 8

তোলপাড় করা সেই ভিডিও : ’কোন সিস্টমে তরে মারতাম খ’


নোমান বিন আরমান : {ভোরের কোমল আলো যখন ফোটছে। সাহরির পর ঘুমন্ত সকলে। সেই আলো ফোটা ভোরে পৈশাচিক উল্লাসে নির্মম ও পেশাদার নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় শিশু রাজন। শেখ সামিউল আলম রাজন নামের তেরো বছরের ওই শিশুকে নির্যাতন করার প্রায় আধাঘণ্টা একটি ভিডিও ক্লিপ তোলপাড়া তুলে ছিল দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে। কী ছিল সেই ভিডিওতে। এনিয়ে ওই ১২ জুলাই সিলেটের সকালের রিপোর্টি পুনর্পাঠ।} রাজনকে নির্যাতনের সময় তাকে উদ্দেশ করে ঘাতকদের বলতে শোনা গেছে, ‘কোন সিস্টমে তরে মারতাম খ, আমরার হখল সিস্টম জানা আছে’। (তোকে কীভাবে মারব বল, আমরার সব পদ্ধতি জানা আছে)। নির্যাতনের সময় ঘাতকরা জানতে চায় সে ‘খুশি’ কিনা। এই বলে তারা রোল দিয়ে তার পায়ে পেটাতে থাকে। এসময় রাজন কাতর সুরে বলে, আড্ডিত মাইর না রেবা, এখটা মারছ খুশি অইছি’। তখন ঘাতকদের একজন বলে, এখটা খাইছ খুশি, দুইটা খাইলে ডবল খুশি’! এই বল তারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। লোমহর্ষক এই নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। গোপন কারও তোলা ভিডিও নয়। খোদ নির্যাতনকারীরাই সেটি পরিকল্পিতভাবে তুলে। এবং উল্লাস করতে করতে তার ভিডিওধারণ করেছে। ‘লাইভ নির্যাতনের’ এই ভিডিওটিও তারা আবার নিজেরাই ফেসবুকে আপলোড করেছে। নির্যাতনকারীদের যে সঙ্গী ভিডিও ধারণ করছিল, তাকে উদ্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায়, ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি-না। ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব…’ জবাব দেয় ভিডিওধারণকারী। রাজনকে তারা নির্যাতন করে হত্যা করেছে চুরির অপবাদে। সিনেমাটিক স্টাইলে চলা অই নির্যাতনের সময় শিশুটির স্পর্শকাতর অঙ্গে বারবার খোচানো হয়েছে। রোলার দিয়ে সেখানে অশ্লীল ইঙ্গিতসূচক ঘা ও আঘাত করা হয়েছে। এইসময় নির্যাতনস্থলের বন্ধ মার্কেটের একটি পিলারের সাথে তাকে পিচমোড়া করে বেধে রাখা হয়েছিল। বাধন খুলে মাটিতে ফেলেও তাকে নানা ‘সিস্টমে’ নিপীড়ন করতে দেখা গেছে। টানা ২৮ মিনিটের ওই ভিডিও চিত্রের প্রতি মুহূর্তের নির্যাতনের নানা ‌’সিস্টম’ পরিলক্ষিত হয়েছে। নির্যাতন সইতে না পেরে শিশুটির আর্তচিৎকারের সময়, সিনেমার মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে ঘাতকরা। আঘাত করতে করতে তারা ঘেমে উঠেছে। সেগুলো সয়ে যাওয়া শিশুটি যখন ‘পানি’ খাওয়ার জন্যে তাদের বারবার অনুনয় করেছে, তখন নির্যাতনকারীরা বলছে, ‘ঘাম’ খা। কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। ঘাতকরা ভেবেছিল, এত নির্যাতনের পর তার আর হাটার শক্তি নেই। সে মাটিতে ধপ করে পড়ে যাবে। কিন্তু ভয়ে হাটতে থাকা শিশুটিকে উদ্দেশ করে তখন তারা বলে, ‘আড়গোড় (হাড়গোড়) দেখি এখনো ঠিক আছে, ইগুরে (ওকে) আরও মারো…’ এরপর রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেকদফা পেটানো হয়। এইভাবে দফায় দফায় শিশুটির নখে, মাথা পেট ও উড়োসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রোল দিয়ে আঘাত করা হয়। এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মুচড়াতেও দেখা যায়। ভিডিওটি এতটাই নির্মম আর পৈশাচিক, সিনেমার ভিলেনরাও এই নিপীড়ন দেখে আতকে উঠবে। কিন্তু এতটুকু গায়ে লাগেনি। এতটুকু দয়া হয়নি ঘাতকদের। তারা তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়েছে। বলেছে, ‘তরে এমন শিক্ষা দিমু, হালার হালা (শালর শাল) জীবনে আর চুরি খরতে (করতে) ফারতে (পাড়বে) নায় (না)’। ঠিকই জীবনই দিয়ে চুরির অপবাদের মূল্য দিয়েছে শিশুটি। সিলেট-সুনামঞ্জ রোডের কুমারগাঁও বাসস্টেশন এলাকার বড়গাঁওস্থ সুন্দর আলী মার্কেটের একটি ওয়ার্কশপের সামনে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হয় রাজনকে। কণ্ঠস্বর ও চিত্র থেকে অনুমেয় ৫/৬ ঘাতক মিলে এই শিশুটিকে নির্যাতন করে। প্রসঙ্গত, গত বুধবার (৮জুলাই) সকাল সাতটার দিকে শিশুটিকে এমন নির্যাতন করে লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়। ওইদিন পর্যন্ত সেটি গুমই ছিল। বুধবার রাত ১১টার দিকে একটি মাইক্রোবাস থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে বুধবার রাত ১১টায় থানায় গিয়ে পরিবারের সদস্যরা শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় পুলিশ বাদি হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় রাজনের লাশ ফেলার সময় হাতেনাতে আটক মুহিত ও তার ভাই কামরুল ইসলাম (২৪), তাদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে (৪৫) আসামি করা হয়েছে। মামলার এজহারনামীয় অন্য আসামিদের গ্রেফতার করতে শনিবার দিবাগত রাতে কুমারগাঁও এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যৌথবাহিনী অভিযান চালালেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। রাজনের বাড়ি কুমারগাঁও বাসস্টেশন পার্শ্ববর্তী সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে। রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান পেশায় একজন মাইক্রোবাসচালক। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে রাজন বড়। অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রাজন সবজি বিক্রি করত। আজিজুর জানান- তিনি যেদিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সেদিন সংসার খরচ চালাতে সবজি বিক্রি করতে বের হয় রাজন। মা লুবনা আক্তার জানান- ওইদিন (বুধবার) রাজনের বাবা গাড়িতে (ভাড়ার ট্রিপে) ছিলেন বলে বাড়ি ফিরেননি। ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য রাজন বের হয়েছিল। সারা দিন ছেলের খোঁজ পাননি তারা। রাতে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার সময় এক কিশোরের লাশ পাওয়ার সূত্র ধরে রাজনকে শনাক্ত করা হয়। লুবনা বলেন- ‘আমার পুয়া (ছেলে) চোর না, ই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। প্রবাসী অখলতের চোর ধরার সখ পূরণ করতে গিয়া জীবন দিছে! আমি এর উচিৎ বিচার চাই।’

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়