Tuesday, July 14

‘আমি মরি যাইয়ার, কেউ বাঁচাও রে বা!’


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: ‘আমি মরি যাইয়ার! কেউ আমারে বাঁচাও রে বা!’ মৃত্যুর আগে এভাবেই আর্তনাদ করছিল ১৩ বছরের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন। এতেও বন্ধ হয়নি নির্যাতন। শেষে আকুতি, ‘আমারে পানি খাওয়াও!’ তখন তাঁর চোখ-মুখ বেয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছিল। তাঁকে বলা হলো ‘পানির বদলা ঘাম খা!’ না রাজনকে ঘাম খেতে হয়নি। ততক্ষণে মৃত্যুই তাকে খেয়ে ফেলেছে। গত বুধবার সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্টেশন এলাকার বড়গাঁওস্থ সুন্দর আলী মার্কেটের একটি ওয়ার্কশপের সামনে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় রাজনকে। নিহত রাজন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের মাইক্রোবাস চালক শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে। রাজনকে হত্যার পুরোচিত্রটি ভিডিও করেছে তার খুনীরা। ২৮ মিনিটের এ ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে কী পৈশাচিক নৃশংসার শিকার হয়ে একজন কিশোর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, বুধবার সকাল ৭টার দিকে খুঁটিতে বেঁধে রাজনকে নির্যাতন করা হচ্ছে। ভিডিওচিত্রে তিন-চারজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিওতে দুজনের চেহারা দেখা গেছে। ওই দুজন রোলার দিয়ে রাজনের মাথা থেকে পা পর্যন্ত থেমে থেমে আঘাত করছিল। ‘এই ক (বল) তুই চোর, তোর নাম ক... লগে কারা আছিল...’ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়ে মারধর করা হয়। ভিডিওতে ঘাতকদের বলতে শোনা গেছে, ‘কোন সিস্টমে তরে মারতাম খ, আমরার হখল সিস্টম জানা আছে’। (তোকে কীভাবে মারব বল, আমরার সব পদ্ধতি জানা আছে)। এক পর্যায়ে ঘাতকরা রোল দিয়ে রাজনের পায়ে পেটাতে থাকে আর জিজ্ঞেস করে সে ‘খুশি’ কিনা। এসময় রাজন কাতর সুরে বলে, ‘আড্ডিত মাইর না রেবা, এখটা মারছ খুশি অইছি’। তখন ঘাতকদের একজন বলে, ‘এখটা খাইছ খুশি, দুইটা খাইলে ডবল খুশি’! এই বল তারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। ভিডিও চিত্রের মাঝামাঝি সময় দেখা যায় ঘাতকরা বারবার কিশোর রাজনের পুরষাঙ্গে রোলার দিয়ে খোঁচাচ্ছে। সেখানে রোলার দিয়ে গুতা দিচ্ছে, আঘাত করছে। যন্ত্রণায় চিৎকার করছে রাজন আর ঘাতকরা অশ্লীল মন্তব্য করে উল্লাস করছে। একনাগাড়ে প্রায় ১৬ মিনিট রাজনকে অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোল দিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে পানি খাওয়ার আকুতি জানায় রাজন। কিন্তু পানির বদলে ‘ঘাম খা’ বলে মাটিতে ফেলে রাখা হয় তাকে। কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। ঘাতকরা ভেবেছিল, এত নির্যাতনের পর তার আর হাটার শক্তি নেই। সে মাটিতে ধপ করে পড়ে যাবে। কিন্তু ভয়ে হাটতে থাকা শিশুটিকে উদ্দেশ করে তখন তারা বলে, ‘আড়গোড় (হাড়গোড়) দেখি এখনো ঠিক আছে, ইগুরে (ওকে) আরও মারো…’। এরপর রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেকদফা পেটানো হয়। এসময় রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ বেশ ফোলা দেখা গেছে। এইভাবে দফায় দফায় শিশুটির নখে, মাথা পেট ও উড়োসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রোল দিয়ে আঘাত করা হয়। এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। ভিডিওটি এতটাই নির্মম আর পৈশাচিক, সিনেমার ভিলেনরাও এই নিপীড়ন দেখে আতকে উঠবে। কিন্তু এতটুকু গায়ে লাগেনি। এতটুকু দয়া হয়নি ঘাতকদের। তারা তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়েছে। ঘাতকরা বলেছে, ‘তরে এমন শিক্ষা দিমু, হালার হালা (শালার শালা) জীবনে আর চুরি খরতে (করতে) ফারতে (পাড়বে) নায় (না)’। এদিকে রাজনকে যে ভিডিও ধারণ করার কাজটি করছিল, তাকে নির্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায় ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি-না। ওপাশ থেকে ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব...’ বলতে শোনা গেছে। শেষ দিকে নির্যাতনকারী একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চায়, ‘কিতা করতাম?’ বলে। অপর একজনকে তখন ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ বলতে শোনা যায়। এদিকে বুধবার সকালে রাজনকে হত্যার পর রাতে মাইক্রোবাসে করে তার লাশ গুমের চেষ্টা করে ঘাতকেরা। এ সময় নির্যাতনকারী বলে অভিযুক্ত সিলেট নগরের কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাসিন্দা মুহিত আলমকে (৩৫) আটক করে পুলিশে দেন এলাকাবাসী। আর ওই সময়েই জালালাবাদ থানায় যান রাজনের মা লুবনা আক্তার। সারা দিন ছেলের খোঁজ না পেয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে থানায় যান তিনি। এ সময় এক কিশোরের লাশ পাওয়ার সূত্র ধরে রাজনকে শনাক্ত করেন তার মা। রাজনের বাড়ি কুমারগাঁও বাসস্টেশনের পাশে বাদে আলী গ্রামে। বাবা শেখ আজিজুর রহমান মাইক্রোবাসচালক। তার দুই ছেলের মধ্যে রাজন বড়। আজিজুর রহমান জানান, তিনি যেদিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সেদিন সংসার খরচ চালাতে সবজি বিক্রি করতে বের হয় রাজন। মা লুবনা আক্তার জানান, ওই দিন (বুধবার) রাজনের বাবা ভাড়া নিয়ে গাড়িতে ছিলেন বলে বাড়ি ফেরেননি। ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য সামিউল বের হয়েছিল। সারা দিন ছেলের খোঁজ পাননি তারা। রাতে থানায় গিয়ে ছেলের লাশের সন্ধান পান তিনি। লুবনা বলেন, ‘আমার পুয়া (ছেলে) চোর না। এ কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। আমি ছেলে হত্যার উচিত বিচার চাই।’ এদিকে সিলেটের জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন জানান, রাজন হত্যার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছে। মামলায় হাতেনাতে আটক মুহিতসহ তার ভাই কামরুল ইসলাম (২৪), তাঁদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে (৪৫) আসামি করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুহিতকে আদালতে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। আজ রবিবার আদালতে রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়