Wednesday, April 29

কিম্ভুতকিমাকার বামুন ডাইনোসর


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: প্রাচীন পৃথিবীর অতিকায় বিলুপ্ত প্রাণি ডাইনোসরের কথা কে না জানে! ভয়াল-দর্শন এই প্রাণিটির সবচে ভয়াল প্রজাতিগুলোর একটির নাম টাইনোসোরাস রেক্স। এবার এই টাইনোসোরাস রেক্সের এক জ্ঞাতি ভাইয়ের খোঁজ মিলেছে। তবে এই দুই জ্ঞাতি ভাইদের আকারে আকাশ-পাতাল গরমিল। টি-রেক্সকে যদি বলি দৈত্য, তবে ওর জ্ঞাতি ভাইটিকে বলতে হবে নিতান্তই পুঁচকে। আকারে ছোট হলে কি হবে, ওর চেহারাটা বড়ই গোলমেলে আর সৃষ্টিছাড়া। একে খুঁজে পাবার পর দুনিয়ার বাঘা বাঘা জীবাশ্মবিদদের তো রীতিমতো আক্কেল গুড়ুম! এক জগাখিচুড়ি চেহারার এই প্রাণিটির ‘একই অঙ্গে অনেক’ প্রজাতির ডাইনোসরের বৈশিষ্ট্য দেখতে পেয়েছেন তারা। বলা বাহুল্য, এমন অদ্ভুতুড়ে আদলের ডাইনোসর কস্মিনকালেও দেখেনি কেউ। বিজ্ঞানীরা এর একটা বাহারি নামও দিয়েছেন—চিলেসোরাস দিয়েগোসুয়ারেসি(Chilesaurus diegosuarezi)! মূলত উদ্ভিদভোজী এই চিলেসোরাসের মাথাটি ক্ষুদ্রাকৃতির, গলা লম্বাটে আর আঙ্গুলগুলো বেঁটে, বেঢপ আর মোটা। মুখের অগ্রভাগ পাখির ঠোঁটের মতো ঈষৎ বাঁকানো আর চ্যাপ্টাকৃতির । অনেকটা প্লাটিপাসের মতো।। দাঁতের আকার চোখা নয় বরং পাতার মতো। এদের দাঁত-মুখের এমনধারা আকারই বলে দেয় এরা ছিল তৃণভোজী। এদের পেছনের পায়ের আকৃতির সাথে থেরোপড প্রজাতির(theropod dinosaurs) ডাইনোসরদের পায়ের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই থেরোপড ছিল ‘প্রাচীন পৃথিবীর সবচে ভয়ানক খুনি’ হিসেবে কুখ্যাত টি-রেক্স, ভেলোসিরাপ্টর ও শিং-অলা অতিকায় কারনোটোরাসদের (T. Rex, Velociraptor and the horned Carnotaurus) গোত্রের। জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা নতুন এই প্রজাতিটির ব্যাপারে মুখ খুলেছেন গত ২৭ এপ্রিল ২০১৫, সোমবার। যদিও এর ফসিলের একটি অংশ প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ২০০৪ সালে। কিন্তু পুরো কংকাল খুঁজে পেয়ে সেসব জোড়া লাগাতে চলে গেছে এতগুলো বছর। কৃতী এই বিজ্ঞানীদের একজন হচ্ছেন ফার্নান্দো নোভাস। আর্হেন্তিনার ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষক। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানালেন চিলেসোরাস দিয়েগোসুয়ারেসির মতো এমন বেঢপ-বিদঘুটে চেহারার ডাইনোসরের দেখা আর কখনো পাননি তারা ("Chilesaurus constitutes one of the most bizarre dinosaurs ever found...’’)। ‘‘প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমরা বুঝিবা তিনটি ভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসরের ফসিল খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু যখন সব হাড়-কঙ্কাল জোড়া লাগালাম তখন বুঝলাম এটা একটা অভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসরেরই ফসিল।’’—এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানালেন ফার্নান্দো নোভাস। এর নাম তারা ‘‘চিলেসোরাস দিয়েগোসুয়ারেসি’’ কেন রাখলেন, সে-কারণও ব্যাখ্যা বর্ণনা করলেন নোভাস। ফসিলটা পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে। ওটা প্রথম খুঁজে পায় দিয়েগো সুয়ারেস নামের ৭ বছরের এক পুঁচকে। ওর দেশ আর ওর নিজের নাম ‘চিলি’ আর ‘সুয়ারেস’—এই দুয়ে মিলে হয়েছে ‘‘চিলেসোরাস দিয়েগোসুয়ারেসি’’। চিলেসোরাসের প্রথম হাড়টি বালক দিয়েগো সুয়ারেস খুঁজে পেয়েছিল ২০০৪ সালে। পুঁচকে সুয়ারেস তার জীববিজ্ঞানী বাবা-মায়ের সাথে আন্দেস পর্বতে ‘নতুন কিছুর সন্ধানে’ বেরিয়েছিল। গিয়েই করলো এই বাজিমাত। এরপর চললো ফসিলের বাকি হাড়গুলোর খোঁজ। এতদিন পর পাওয়া গেল চিলেসোরাসের পুরো কংকাল। পরে সেসব জোড়া লাগানো হলো। থেরোপড প্রজাতির অতিকায় টি-রেক্স ডাইনোসরদের গলা তুলনামূলকভাবে বেঁটে, মাথাটা বিশালাকায় প্রকাণ্ড থামের মতো ওর পেছনের দু’পায়ের পেশীও ছিল আর প্রচণ্ড গাট্টাগোট্টা। ওদের নখরও ছিলো বিরাট আর ভীতিকর। অতিকায় চোয়াল জুড়ে বসানো ছিল তীক্ষ্ণ-ধারালো দাঁতের পাটি। কিন্তু ‘‘চিলেসোরাস দিয়েগোসুয়ারেসি’’ নামের টি-রেক্সদের এই বামুনাকৃতির নিকটাত্মীয়টি লাগিয়ে দিয়েছে যতো গণ্ডগোল। জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের আগের সব ধারণাই সে দিয়েছে পাল্টে। যেমন, আকার অদ্ভুতুড়ে হলেও টি.রেক্সের মতো মোটেই ভয়াল দর্শন নয় সে। নিজের গোত্রের অন্য ভাই-বেরাদরদের সাথে চেহারা ও আকারে মিল থাকার কথা ছিল তার। অথচ মিল একদমই নেই। সাধে কি আর জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের চোখ কপালে উঠেছে! ‘‘চিলেসোরাস দিয়েগোসুয়ারেসি’’ তাদের জন্য এক মহাবিস্ময়ের খোরাক যুগিয়েছে। এ-কারণে ‘‘গোলকধাঁধার ডাইনোসর’’ বলে একটি গালভরা অভিধাও জুটেছে এর। ‘গোলকধাঁধার ডাইনোসর’: ভয়াল দর্শন টি-রেক্সের আত্মীয় হলে কি হবে, চিলেসোরাসের খুলির আকৃতি ছিল খুবই ছোট। চোয়াল বলতে কিছুই ছিল না তেমন। বরং ওর মুখের গড়ন অনেকটা পাখির ঠোঁটের আকৃতির। প্লাটিপাসের চ্যাপ্টা ঠোঁট যেমন। এর উপর বসানো ঈষৎ সূঁচালো আকারের নাসারন্ধ্র। দাঁতের আকৃতি পাতার মতো। সামনের দু’পায়ের প্রতিটিতে মাত্র একজোড়া নখ। বলতেই হবে, টি-রেক্সের ভয়াল-করাল মূর্তির পাশে নিতান্তই গোবেচারা চেহারা! যেন দৈত্যের পাশে বামুন। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গোলিয়াথ’ আর ‘ডেভিড’! তাহলে কতোটা খর্বাকৃতির ছিল এরা? কোনো কোনোটি আকার নাকি ছিল পূর্ণবয়স্ক টার্কির মতো---আকার এতোটাই ছোট। অবশ্য কোনো কোনোটি তিন মিটার পর্যন্ত লম্বাও হতো। বিজ্ঞানীদের বিস্ময়টাও একারণেই। এদের অদ্ভুতুড়ে আকৃতি নাকি একইসঙ্গে অনেক প্রজাতির ডাইনোসরের আকৃতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ফার্নান্দো নোভাস ও তার সতীর্থ বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ করেছেন, আজকের দিনের প্লাটিপাসের মুখাবয়ব ও ঠোঁটের সাথে মিল, বিভারের মতো লেজ আর উদবিড়ালের মতো পা ---সবকিছু মিলে ওরা ছিল জগাখিচুড়ি আর কিম্ভুত এক প্রজাতি। এসব জেনে সুকুমার রায়ের ‘হাঁসজারু’র কথা মনে পড়ে যায় আমাদের। এরা যে ছিল একের ভেতর বহু, সেটাই হতবাক করার মতো ব্যাপার বটে। ফার্নান্দো নোভাসের কথায়ই তা স্পষ্ট: "We are puzzled by the weird anatomy of Chilesaurus, which recalls different dinosaurian groups," তার ধারণা, এই কিম্ভুত প্রজাতিটি ভবিষ্যতে জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিস্তর বিতর্কের জন্ম দেবে। আর তৃণভোজী ডাইনোসরের আবির্ভাব যে সময় হয়েছিল বলে ধারণা, সে ধারণাও পাল্টে দিয়েছে এই পুঁচকে চিলেসোরাস। মানে দাঁড়াচ্ছে, প্রচলিত ধারণার চেয়ে বহু লক্ষ বছর আগেই ওদের আবির্ভাব ঘটেছিল। চিলেসোরাসদের আবির্ভূত হয়েছিল জুরাসিক যুগের শেষ দিকে; আজ থেকে ১৪ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে।অর্থাৎ ওরা ছিল ভীষণাকৃতির টি-রেক্সদেরও পূর্ব পুরুষ। টি-রেক্সেদের আবির্ভাব ঘটেছিল এদের অনেক পরে ক্রেটাসিয়াস যুগে ---আজ থেকে ৭ কোটি থেকে ৬ কোটি পঞ্চাশ লাখ বছর আগে। আকারে ছোট হলেও ওরা যে ছিল ভয়াল-বিপুল রি-রেক্সদেরও দাদার দাদা! !

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়