Friday, March 6

আল্লাহর শোকরই মুমিনের শ্রেষ্ঠ গুণ


ইসলাম ডেস্ক, কানাইঘাট নিউজ: সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এজন্য তাকে দেয়া হয়েছে সর্বোত্তম আকৃতিও। তাকে দান করেছেন সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। আর অন্যসব সৃষ্টিকে নিয়োজিত রেখেছেন মানুষেরই কল্যাণে। ইরশাদ হচ্ছে- নিঃসন্দেহে আমি সৃষ্টি করেছি মানবজাতিকে সর্বোত্তম আকৃতিতে (সূরা তিন, আয়াত-৪)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- অবশ্যই আমি সম্মান দান করেছি আদম সন্তানকে। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৭০)। বিশ্বজগতের সবকিছু পশু-পাখি, গাছ-পালা, নদী-সাগর, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ও আসমান-জমিন সবকিছুকে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য এবং নিয়োজিত রেখেছেন মানুষেরই কল্যাণে। ইরশাদ হচ্ছে- তিনি ওই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন জমিনের সবকিছু। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৯)। অন্যত্র ইরশাদ করেছেন- আর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সবকিছু। (সূরা জাসিয়া, আয়াত-১৩)। এছাড়াও আল্লাহতায়ালা মানুষকে দান করেছেন অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত। ইরশাদ করেছেন- যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা করতে থাক তাহলে (গণনা করে) তোমরা তা শেষ করতে পারবে না। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৩৪)। এখন প্রশ্ন হল কেন আল্লাহ আমাদের এতসব নেয়ামত দান করলেন? এবং এ নেয়ামত লাভ করার পর আমাদের করণীয় কী? দয়ালু আল্লাহ এ প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ করে নাজিল করেছেন- হে লোক সকল; তোমরা ইবাদত কর তোমাদের ওই রবের যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। (সূরা বাকারা, আয়াত-২১)। অন্যত্র নাজিল করেছেন- তোমরা আমাকে স্মরণ কর তাহলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ রাখব। আর আমার শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায় কর, আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হইও না। (সূরা বাকারা আয়াত ১৫২)। বান্দা হিসেবে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে, আল্লাহর জিকির, ইবাদত এবং শোকর ও আনুগত্যের জন্য রবের পক্ষ থেকে এ আদেশ নাজিলই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানবস্রষ্টা, মানব প্রকৃতি ও মানব দুর্বলতা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তাই তিনি শোকর ও আনুগত্যের বিপরীতে পুরস্কারের ঘোষণা করলেন আর অকৃতজ্ঞতা ও নাফরমানির বিপরীতে শাস্তির হুশিয়ারি শোনালেন। ইরশাদ করলেন- যদি তোমরা শোকর আদায় কর তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে (নেয়ামত) বৃদ্ধিই করে দেব। আর যদি শোকর আদায় না কর (তাহলে জেনে রেখ) নিঃসন্দেহে আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৭)। সুতরাং অবশ্যই আমাদের নেয়ামতের শোকর আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, শোকর আদায়ের তরিকা কী? কোন নেয়ামতের শোকর আমরা কোন তরিকায় আদায় করব? প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী নেয়ামত লাভের পর মুখে মুখে আলহামদুলিল্লাহ বললেই কি শোকর আদায় হয়ে যাবে? এভাবে শোকর আদায় করলেই কি আমরা পুরস্কার লাভের যোগ্য বিবেচিত হব? আরব শায়খ আলী তানতাভী (রহ.) বলেছেন, ‘না, এভাবে শোকর আদায় করে শোকর আদায়ের শর্তে নেয়ামত বৃদ্ধি করে দেয়ার যে ঘোষণা দরবারে ইলাহি থেকে দেয়া হয়েছে, আমরা তার হকদার কিছুতেই হতে পারব না। আর যথার্থ অর্থে এটাকে শোকর আদায়ও বলা যায় না।’ তিনি লিখেছেন- ‘শোকর আদায় এমন বিষয় নয় যে, মৌখিক আলহামদুলিল্লাহ বললেই তা আদায় হয়ে যাবে। মুখে মুখে হাজারবার আলহামদুলিল্লাহ বললেও নেয়ামতের যথার্থ শোকর আদায় হবে না। নেয়ামতের যথার্থ শোকর আদায়ের অর্থ হল, প্রাপ্ত নেয়ামত থেকে প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তিকে সামর্থ্য অনুযায়ী দান করা। সুতরাং ধনীর শোকর আদায় হল দরিদ্রকে দান করা, সবলের শোকর আদায় হল দুর্বলকে সহায়তা করা, সুস্থের শোকর আদায় হল অসুস্থের সেবা করা এবং শাসকের শোকর আদায় হল প্রজাদের জন্য ন্যায়-বিচার। তো আমি যদি তৃপ্ত থাকি আর আমার প্রতিবেশী যদি ক্ষুধার্ত থাকে, আমি যদি আরাম-আয়েশে থাকি আর আমার প্রতিবেশী যদি শীত-গরমে কষ্ট করে তাহলে সামর্থ্যানুযায়ী প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেয়া এবং সাধ্যানুযায়ী তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করাই হবে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামতের যথার্থ ও কার্যত শোকর আদায়। তো আমরা যদি মৌখিক শোকর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে উল্লিখিত পদ্ধতিতে কার্যতও শোকর আদায় করি তাহলে শোকর আদায়ের শর্তে নেয়ামত বৃদ্ধি করে দেয়ার যে ঘোষণা দরবারে ইলাহি থেকে দেয়া হয়েছে, আমরা তার হকদার অবশ্যই হব ইনশাআল্লাহ। আর নেয়ামতের যথার্থ শোকর আমরা যদি আদায় না করি তাহলে ‘আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন’ এ সতর্কবাণীরই ‘মিসদাক’ আমরা হব। আর এ শাস্তির সর্বনিু এবং দুনিয়াবি পরিণাম কী হবে তাও আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন। তা হল প্রাপ্ত নেয়ামত হাতছাড়া হওয়া। ইরশাদ করেছন- (হে নবী) আপনি বলুন, ইয়া আল্লাহ! হে রাজত্বের মালিক! যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন আর যার থেকে ইচ্ছা করেন রাজত্ব ছিনিয়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা ইজ্জত-সম্মান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা অপমান-অপদস্ত করেন। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-২৬)। এ আয়াতের তাফসিরে মুফাসসিররা লিখেছেন, কোনো শাসক যদি রাজত্ব লাভ করার পর ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে রাজ্য শাসন না করেন অর্থাৎ রাজত্বের যে নেয়ামত আল্লাহ তাকে দান করেছেন তিনি যদি এর যথার্থ শোকর আদায় না করেন তাহলে আল্লাহ তার থেকে রাজ্য ছিনিয়ে নেন। শায়খ আলী তানতাভী (রহ.) শোকর আদায়ের যে তরিকা পেশ করেছেন তা কোরআনে নির্দেশিত তরিকা। শোকর আদায়ের এ তরিকা কোরআনই আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। সূরা দুহায় আল্লাহতায়ালা নবী আলাইহিস সালামকে তিনটি নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে ওই নেয়ামতের শোকর আদায়ের তরিকা শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন- তিনি (আল্লাহ) কি আপনাকে ইয়াতিম পেয়ে আশ্রয় দান করেননি? এবং তিনি কি আপনাকে (দ্বীন ও শরিয়তের) জ্ঞানশূন্য পেয়ে জ্ঞান দান করেননি? এবং তিনি কি আপনাকে অভাবগ্রস্ত পেয়ে অভাবমুক্ত করেননি? (সূরা দুহা, আয়াত ৬-৮)। এর পরপরই এসব নেয়ামতের শোকর আদায়ের তরিকা শিক্ষা দিয়ে ইরশাদ করেছেন- সুতরাং ইয়াতিমের প্রতি আপনি কঠোর হবেন না। আর (অভাবগ্রস্ত) প্রার্থীকে আপনি ধমক (দিয়ে ফিরিয়ে) দেবেন না। আর আপনার রবের নেয়ামতের কথা আপনি আলোচনা করুন। (সূরা দুহা, আয়াত ৯-১১)। কোরআনে নবী আলাইহিস সালামকে মম্বোধন করে প্রকৃত অর্থে আল্লাহতায়ালা উম্মতকেই শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমাদের উচিত রাব্বে কারিম আমাদের যাকে যে নেয়ামত দান করেছেন সে নেয়ামতের যথার্থ শোকর আদায় করা। অর্থাৎ প্রাপ্ত নেয়ামত থেকে নিজ নিজ সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনগ্রস্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলেই দূর হতে পারে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভেদ-বৈষম্য এবং ফিরে আসতে পারে শান্তি ও ঐক্য। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়