Saturday, November 1

স্বচ্ছ জলরাশির তলদেশে স্বর্গের বাগান


কানিউজ ডেস্ক: মুক্তোর মতো ঝকঝকে সাদা বালুতট, দিগন্তবিস্তৃত নীল জলরাশি আর গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজের চুড়ো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অগুনতি নারিকেলবীথির সারি। সবার মানসপটে দ্বীপদেশ মালদ্বীপের ছবিটা এমনই। তবে বহু বিচিত্র রত্নভান্ডার নিয়ে এর স্বর্গের বাগানটা কিন্তু স্বচ্ছ জলরাশির তলদেশে। আর পরিবেশবান্ধব পর্যটনে মালদ্বীপ পৃথিবীর অন্যতম সেরা তীর্থ হয়ে উঠছে সাগরতলের ওই অদেখা স্বর্গোদ্যানের জন্যেই। পর্যটক হিসেবে সাগরতলে ভ্রমণের পাশাপাশি মালি হিসেবেও আপনি যোগ দিতে পারেন ওই বাগানের পরিচর্যায়। এলনিনো, সুনামি ও সমুদ্র-উদ্যান রংধনুর সাতরংকে হার মানানো বহু বিচিত্র প্রবাল আর সাগরতলের নানা উদ্ভিদের ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়ানো বাহারি মাছ, সামুদ্রিক প্রাণীর অভয়ারণ্য মালদ্বীপের সাগরতলের এ বাগান। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ‘এলনিনো’র আক্রমণে অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সাগরতলের এ উদ্যান। হঠাৎ হঠাৎ সমুদ্র-রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ধেয়ে যায় সাগরের এ সাময়িক উষ্ণ স্রোত এলনিনো। সমুদ্র জীববিজ্ঞানীরা মনে করছেন দেশটির প্রবালপ্রাচীরের প্রায় ৯০ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে ওই এলনিনোর কারণে। সমুদ্রতলের তাপমাত্রা মাত্র এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়লেই সাদা বিবর্ণ হয়ে যায় প্রবাল, প্রবালের ভেতরের সব হাড়গোড় যেন বেরিয়ে পড়ে, ভয়াবহ নাজুক হয়ে পড়ে ওদের অস্তিত্ব। কিন্তু সেবার মালদ্বীপের সাগরতলে তাপমাত্রা বেড়েছিল প্রায় চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এ মহাবিপর্যয়ের পর ২০০৪ সালে আসে ভারত মহাসাগরের প্রলয়ংকরী সুনামি। ফলে এলনিনোর আঘাতের পর মালদ্বীপের প্রবাল রাজ্যের যে পরিচর্যা শুরু হয়েছিল তা আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু পিছু হটেননি সমুদ্র-অন্ত-প্রাণ বিজ্ঞানী আর পরিবেশবান্ধব পর্যটনের অগ্রসৈনিকেরা। সাগরতলে প্রবালবাগানের পরিচর্যা মালদ্বীপের দ্বীপগুচ্ছগুলোর প্রবাল প্রাচীরে নতুন করে প্রবালের বনায়ন এবং প্রবাল পরিচর্যার উদ্যোগ সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কষ্টসাধ্য এ কাজে সমুদ্র জীববিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক, স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকেরাও। সাগরতলে প্রবালপ্রাচীরের ভেঙে যাওয়া কাঠামো জোড়া লাগাতে নতুন করে প্রবাল লাগাচ্ছেন তাঁরা। কোথাও কোথাও সুরক্ষা নিশ্চিতে তৈরি করছেন নতুন কাঠামোও। আবার কোথাও তাঁদের করতে হচ্ছে সামুদ্রিক উদ্ভিদরাজির বিশালাকৃতির সব জিগজাগ ধরনের কাঠামো মেরামতের কাজ। তবে আশার কথা হল ‘স্ট্যাগহর্ন’ এবং ‘টেবল’ প্রবালের মতো দ্রুত বর্ধিঞ্চু ‘অ্যাক্রোপোরা’ জাতীয় প্রবালগুলো এক বছরের মধ্যেই দারুণভাবে বেড়ে উঠছে। মালদ্বীপের ‘বা’ প্রবাল দ্বীপপুঞ্জের বিলাসবহুল অনন্তরা রিসোর্টের আবাসিক সমুদ্রতল-বিশেষজ্ঞ ইভলিন শ্যভেঁ সাগরতলের বাগান পরিচর্যা বিষয়ে জানিয়েছেন, ‘এটা নিঃসন্দেহে একটি অগ্রগতি এবং আমাদের সবার এটাই চাওয়া উচিত।’ সমুদ্রবিজ্ঞান চর্চায় এই দ্বীপগুচ্ছে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন এমন ছয়জন বিজ্ঞানীর অন্যতম শ্যভেঁ বলেন, ‘কিছু কিছু প্রবাল এতই দ্রুত বাড়ছে যে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। এগুলো বছরে প্রায় আড়াই সেন্টিমিটার করেও বাড়ছে। এটা আশাব্যাঞ্জক।’ এ সমুদ্র-জীববিজ্ঞানী আরও বলেন, একবার ভাবুন সাগরতলে একজন পর্যটকের লাগানো প্রবালবাগানটি দেখতে বহু বছর পর তিনি ফিরে আসলেন। এসে দেখলেন তাঁর ওই বাগান ঘিরে সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দারুণ এক প্রাণের মেলা চলছে সেখানে। এমন স্থায়িত্বমূলক পর্যটনের অভিজ্ঞতা অমূল্য। সমুদ্র-রাজ্যের শিক্ষা ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্বচ্ছ জলরাশির তলদেশে স্বর্গের বাগান মালদ্বীপের বেশ কয়েকটি দ্বীপগুচ্ছে পর্যটন এবং সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সমুদ্র তলদেশের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলা এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটনের চর্চা। প্রবালের পুনর্বনায়ন এবং প্রবাল চাষের প্রকল্পগুলো ঘিরে চলে এ চর্চা। স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়, স্কুলের কিশোর-কিশোরী এবং নানা দেশ থেকে আসা পর্যটকেরা একাজে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে শিক্ষিত হচ্ছেন। এ প্রকল্পের আওতায় তারা চাইলে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে নিজের বাড়ির বাগানের মতোই নিজস্ব প্রবালবাগান তৈরি করতে পারেন। আরও আকর্ষণীয় হল একজন বিদেশি পর্যটকও তাঁর পরিচর্যায় লাগানো প্রবালবাগানের বেড়ে ওঠা এবং পরবর্তী অবস্থার খোঁজখবর রাখতে পারবেন, অনলাইনে বসে সেগুলোর ছবিও দেখতে পারবেন। মালদ্বীপের যে দ্বীপগুচ্ছগুলোতে এমন পর্যটন সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে তার মধ্যে ‘বা’ দ্বীপগুচ্ছ, দক্ষিণ মালে দ্বীপগুচ্ছ অন্যতম। এসব দ্বীপগুচ্ছের কিহাভাহ হুরাভালহি, লান্দা গিরাভারু, ধিগু, ভেলি ও নালান্ধু দ্বীপেই প্রবাল পুনর্বনায়নের কর্মকাণ্ড বেশি হচ্ছে। ৭৫টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ‘বা’ দ্বীপগুচ্ছে যেতে রাজধানী মালে থেকে বিমানে লাগে মাত্র ৩৫ মিনিট। অন্যান্য সমুদ্র-উদ্যানের চেয়ে এখানে মাছের বৈচিত্র্য অনেক বেশি। কিহাভাহ হুরাভালহি দ্বীপেই রয়েছে ‘অনন্তরা কিহাভাহ রিসোর্ট’। এদের সমুদ্রতল পর্যটনে অংশ নিয়ে আপনি সকালবেলার ডুবসাঁতারে দেখে আসতে পারবেন প্রবাল বাগানের নানা দৃশ্য, প্রবাল পরিচর্যার কলাকৌশল। কিহাভাহ সমুদ্রতলে বাগানচর্চায় খুবই জনপ্রিয় হলেও এটাই সমুদ্র-রাজ্যে শিক্ষার একমাত্র জায়গা নয় মালদ্বীপে। একই দ্বীপগুচ্ছে অবস্থিত ‘দুসিত থানি রিসোর্টে’ আপনি একজন সমুদ্র-জীববিজ্ঞানীর সঙ্গে সাগরের তলদেশে শিক্ষা-পর্যটনে যেতে পারবেন। দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ সুরক্ষায় পর্যটকেরা এখানকার প্রবাল বাগানে প্রবাল লাগানোরও সুযোগ পান। লান্দা গিরাভারু দ্বীপের ‘ফোর সিজনস রিসোর্ট মালদ্বীপস’-এর প্রবাল চাষ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার প্রবালের কাণ্ড লাগানো হয়েছে। এ সাফল্য ইতিমধ্যেই তাদেরকে সমুদ্রতলে বিশ্বের অন্যতম সফল পুনর্বনায়ন প্রকল্পের মর্যাদা এনে দিয়েছে। বিশ্বের প্রথম কার্বন-নিরপেক্ষ দেশ মালদ্বীপ! প্রকৃতি সুরক্ষায় নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের মুকুটটি মাথায় পড়তে ২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রথম কার্বন-নিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে মালদ্বীপ। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ‘কার্বন নিঃসরণে’র বিপরীতে সমপরিমাণ ‘কার্বন শোষণে’র জন্যে নানান প্রকল্প হাতে নিয়েছে মালদ্বীপ সরকার। এসব প্রকল্পের অন্যতম প্রচারমন্ত্রও হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পর্যটন। সমুদ্র তলদেশের পরিবেশ সুরক্ষা প্রবালদ্বীপপুঞ্জ মালদ্বীপের অস্তিত্বের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে একদিন তলিয়ে যেতে পারে পুরো দ্বীপপুঞ্জটিই। কারণ, সমুদ্রসমতল থেকে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে মাত্র চার ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে নিচুভূমির দেশ মালদ্বীপ। এ দ্বীপপুঞ্জে কোনো পাহাড়ি এলাকা তো নেইই বরং মাত্র সাত ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ‘কম প্রাকৃতিক উচ্চতা’র দেশও মালদ্বীপ। একই সঙ্গে জনসংখ্যা ও আয়তনে এশিয়ার সবচেয়ে ছোট দেশও

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়